• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
শিক্ষকতা পেশা : বোরিং না আনন্দময়

প্রতকী ছবি

মতামত

শিক্ষকতা পেশা : বোরিং না আনন্দময়

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

উদীয়মান একদল মানবশিশু বা তরুণদের জীবন, জগৎ এবং বিশ্বের বিবিধ রহস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত যে কর্মীবাহিনী তারাই শিক্ষক নামে পরিচিত। এ পেশার সঙ্গে যারা জড়িত স্বভাবতই তারা অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে একটু আলাদা। এ পেশায় যারা পূর্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা সাধারণত ভোগ-বিলাস ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন। পৃথিবী পাল্টেছে, শিক্ষকতা পেশাও পাল্টেছে। পরিবর্তন এসেছে এ পেশায় নিয়োজিতদের। বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান এখন আর শিক্ষকদের মধ্যে তেমন একটা চোখে পড়ে না। এখন তারা ঘড়ি ধরে ৫৯ মিনিট পড়ান। এক মিনিটের মধ্যে অন্য আরেকটি ব্যাচকে ঢোকার সুযোগ দেন। অনেক শিক্ষক গর্ব করে বলেন, ‘বাসা নয় স্বর্গ বানিয়েছি।’ তার বা তাদের এই স্বর্গ বানানোর অর্থ ঘুষের টাকা থেকে আসেনি, এসেছে প্রাইভেট পড়ানো টাকা থেকে। এগুলো সবই পরিবর্তন। তবে এগুলো সবই পজিটিভ পরিবর্তন নয়। আমি যে পরিবর্তনের কথা বলতে যাচ্ছি সেটি হচ্ছে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন।

এখন শিক্ষাদান পদ্ধতি হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক। অর্থাৎ শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সবাই অংশগ্রহণ করবে। পূর্বে ধারণা ছিল শুধু শিক্ষক শিক্ষাদান করবেন এবং ছাত্রছাত্রীরা তা শুধু শুনবে। কিন্তু এই একমুখী শিক্ষাদান ছাত্রছাত্রীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে না। এতে তারা কম উপকৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শ্রেণিতে শুধু শিক্ষক নিজে কথা বলছেন এবং শিক্ষার্থীরা শ্রবণ করছে, সে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ৩০ ভাগ উপকৃত হয়। আর যে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করছে, তারা ওই ধরনের ক্লাস থেকে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ উপকৃত হয়। এখন আধুনিক শিক্ষক হচ্ছেন তিনি, যিনি তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাতে পারেন। কীভাবে অংশগ্রহণ করাবেন, তার কতগুলো পদ্ধতি আছে। যেমন- দলগত কাজ, জুটিবদ্ধ কাজ,  এলিসিটেশন, রোল প্লে ইত্যাদি।

আমি অনেক শিক্ষককে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রশ্ন করেছি- আপনি শিক্ষকতা পেশায় কতটা সন্তুষ্ট বা এ পেশা কতটা উপভোগ করছেন? ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বলেছেন, বোরিং পেশা। ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন শিক্ষক মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকুন বা না থাকুন, ক্লাসে তাকে ঢুকতেই হচ্ছে। আর ক্লাসে ঢুকে তাকে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। ক্লাসের সাইজ (সংখ্যানুপাতে) ছোট হলে এক ধরনের ম্যানেজ করা যায়, কিন্তু ক্লাস সাইজ বড় হলে শিক্ষক এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে ভোগেন। কারণ ৫০-৬০ কিংবা তারও বেশি শিক্ষার্থী একটি ক্লাসে থাকে আর প্রায় সবাই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চরিত্রের অধিকারী। তারা তাদের স্বভাবসুলভ আচরণ করবে, ক্লাসে যদি তাদের ভীষণভাবে ব্যস্ত রাখা না যায়। তা না হলে কেউ চেঁচামেচি, কেউ চিৎকার, কেউ খোঁচাখুঁচি করবে। আর শিক্ষক যদি চুপচাপ থাকেন তা হলে তো কথাই নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কখনই বিনা কাজে চুপচাপ বসে থাকবে না। তাদের বয়স, প্রয়োজন, চাহিদা, সিলেবাস ও পরীক্ষা মোতাবেক কোনো কাজে ব্যস্ত না রাখলে তারা মজা পাবে না, তাই এসব দিকে খেয়াল রেখে একজন শিক্ষককে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে হয়।

তা ছাড়া একজন শিক্ষকের কাজ তো শুধু ক্লাসেই নয়; টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেওয়া, খাতা পরীক্ষণ করা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, পরীক্ষার ডিউটি করা ইত্যাদিসহ অনেক ধরনের কাজ একজন শিক্ষককে করতে হয়। আর এসব কারণে একজন শিক্ষক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় ভালোভাবে ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে পারেন না। নতুন কিছু জানার ও শেখার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি হয়তো অনেক সময় তা পেরে ওঠেন না।

তাহলে এর সমাধান কী? সমস্যা ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। আপনি ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বেশি ঝুঁকি নিলে হয়ত সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত সমস্যার কিছু সমাধান দিতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো আপনার তেমন কিছু করার নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর একই ধরনের কাজ, ক্লাস, বিদ্যালয় নিতান্তই একঘেয়েমি। যত একঘেয়েমিই হোক কাউকে না কাউকে তো এই মহান ব্রত ও দায়িত্ব পালন করতেই হবে। একদল নিঃস্বার্থ মানুষের তো এগিয়ে আসতে হবে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে। তাই হাজারো সমস্যা আছে এই পেশায়, তারপরও অনেক শিক্ষক এখানে চাকরি করেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন এই মহান পেশায়। বিনিময়ে জীবনব্যাপী দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেন, আপস করেন না কোনো মিথ্যার সঙ্গে, অসত্যের সঙ্গে।

কেউ কেউ আবার শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে ব্যাংকিং পেশায় চলে আসেন। শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য?  না, শুধু তাই নয়। ব্যাংকিং পেশার চাপ তারা সহ্য করতে রাজি, কিন্তু শিক্ষকতার শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সহ্য করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকতা পেশায় ওপরে ওঠার তেমন কোনো ধাপ নেই, খুব সীমিত ধাপ। এটিও বোরিং হওয়ার আরেকটি কারণ। একজন শিক্ষককে প্রতিদিন ৪-৫টি ক্লাস নিতে হয়।  ক্লাসের পুরো সময়ই যদি তিনি কথা বলেন তাহলে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। তাই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে লাগাবেন, আর তাই আপনাকে ‘টিচার টকিং টাইম’ কমাতে হবে বাড়াতে হবে ‘স্টুডেন্ট টকিং টাইম’। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করাতে পারলে তারা ক্লাসে মজা পাবে, আপনার চাপ কমবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি সুস্থ থাকবেন। নতুনভাবে চিন্তা করুন কীভাবে ক্লাসকে আপনার ও শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় করা যায়। স্কুল আপনার আনন্দের জায়গা, খেলার জায়গা, উপার্জনের জায়গা এবং বিনোদনের জায়গা। এই কথা মনে করুন সব সময়।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন আপনার বিদ্যালয়ে। যেমন- গণিত মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান মেলা ও অলিম্পিয়াড, ইংরেজি সপ্তাহ, কুইজ কম্পিটিশন ইত্যাদি। নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আপনার প্রশাসনিক, পেশাগত ও সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, আনন্দ পাবেন কাজে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সমিতি,  পেশাগত সমিতিগুলোর সদস্য হোন। শিক্ষামূলক ম্যাগাজিন/পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করুন, বিভিন্ন স্তরের ও দেশের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুন। এগুলোর কারণে আপনার আলাদা একটি জগৎ সৃষ্টি হবে, সেই ভুবন হবে আপনার আনন্দের ভুবন।

 

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার

ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads