• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
চলচ্চিত্র শিল্প : গল্প সমন্বয় ও অর্থ ব্যবস্থাপনা

এদেশের দর্শক ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

চলচ্চিত্র শিল্প : গল্প সমন্বয় ও অর্থ ব্যবস্থাপনা

  • প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সাদিকুর সাত্তার আকন্দ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বললে অনেকেই নাক সিটকান। যেন বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মানা অথবা ভাবখানা এমন হয় যেন এদেশের চলচ্চিত্র কোনো নিকৃষ্ট জিনিস। মোটাদাগে বললে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ছোট করে দেখার অর্থ হলো এদেশের সংস্কৃতি ও শিল্পকে শ্রদ্ধা না করা বা সম্মান না দেখানো। এদেশের তরুণ সমাজের একটা অংশ বাংলা সিনেমার কথা শুনলেই কেমন যেন এড়িয়ে যান। মূলত তারা দেশীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব ও পটভূমি সম্পর্কে একটু বেখেয়াল। এদেশের চলচ্চিত্র শিল্প কখনোই অবহেলা কিংবা হাসির উপকরণ ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল পার্শ্ববর্তী কয়েকটা দেশের জন্য সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশে যখন চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয় তখন আশপাশের অনেক দেশেই এত বড় স্টুডিও ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এফডিসি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এদেশকে সংস্কৃতিচর্চার আঁতুড়ঘর হিসেবে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এর পর থেকে অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এদেশে। অথচ সেই বাংলাদেশ আজ প্রায় সিনেমাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ভিনদেশি সিনেমা সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে। এটি এদেশের মানুষ এমনকি সংস্কৃতিমনাদের জন্য মোটেও সুখকর সংবাদ নয়। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে ভিনদেশি চলচ্চিত্র কিংবা নাটক অথবা ধারাবাহিক আমাদের দেশের সিনেমা কিংবা সংস্কৃতির জন্য খুব বেশি নেতিবাচক বা ঝুঁকি বলে মনে হয় না। কিন্তু একটু খেয়াল করলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব আঁচ করতে পারা যায়। প্রথমে মানসিক দিকটি খেয়াল করি। আমরা যখন বিদেশি সিনেমা বা নাটক দেখি এবং ক্রমাগত এই দেখার হার বাড়তে থাকে তখন মনের অজান্তেই আমরা ওই ভিনদেশি আচার-আচরণ এমনকি শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও নিজেদের মধ্যে নিয়ে আসি। যা পরবর্তী সময়ে স্বদেশি সংস্কৃতির প্রতি আমাদের আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের শিকড়- এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। যে কারণে নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ববোধের কথা আমাদের মনে থাকে না। বর্তমানে দেশে যেকোনোভাবে বিদেশি সিনেমা ও সিরিয়াল অহরহই চলছে এবং এগুলোর দর্শকও প্রচুর। এর কারণ কী? যেখানে আমাদের দেশে এত সুন্দর নাটক ও ধারাবাহিক তৈরি হচ্ছে সেগুলোর তেমন প্রত্যাশিত সাড়া নেই। কারণ খুঁজলে আমরা পাই দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি গুরুত্বহীনতা। যা আমাদের দর্শককে ভিনদেশি সংস্কৃতির যে আধিপত্য তা বুঝতে দিচ্ছে না। এভাবে এদেশের দর্শক ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, ভারতীয় সিনেমা ও সিরিয়ালগুলো বড়পর্দা থেকে শুরু করে ছোটপর্দা সব জায়গায় দাবিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের দেশে।

ভিনদেশি সিনেমা ও সিরিয়ালের দৌরাত্ম্য যদি এদেশে কমাতে হয় তাহলে কী করণীয় ও বর্জনীয় তা বহুজন বহুবার আলোচনায় এনেছেন। আমাদের দেশের দর্শকদের যদি দেশি সিনেমাবিমুখ হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয় তারা অহরহই বলেন, ‘গল্প ভালো না’, পরিচিত গল্প, ইত্যাদি। সাথে সাথে তারা বাংলা সিনেমার সোনালি দিনের কথাগুলোও আফসোসের সুরে বলে। বাংলাদেশের সিনেমা একটা সময় কলকাতা ও বলিউডে রিমেক হতো। আর এদেশের গান, সঙ্গীত ও চিত্রনাট্য তো অহরহই অনুসরণ করা হতো ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক সিনেমায়। খুব বেশি আগের কথা না, গত ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি আলোচিত সিনেমা রিমেক হলো দক্ষিণ ভারতের ইন্ডাস্ট্রিতে। সুতরাং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে হতাশার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, এদেশের মানুষ কেন বিমুখ হলো?

এ প্রশ্ন চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এড়াতে পারেন না। কারণ ভালো গল্পের সিনেমা তৈরি হলে দর্শক এখনো হলে যায়। অতএব ভালো গল্প তৈরি করতে হবে। পরিচালকসহ যারা সিনেমার গল্প তৈরির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট তাদেরকে ভাবতে হবে নতুন করে। এমন কিছু ঘটনা বা চিন্তাকে গল্পে রূপ দিতে হবে, যা আসলেই মানুষকে ভাবায় বা চিন্তার খোরাক দেয়। গতানুগতিক গল্প দর্শক নিজেই জানে। সুতরাং গল্প তৈরির বেলায় প্রান্তিক পর্যায় থেকে ভাবতে হবে সিনেমাওয়ালাদের। প্রত্যেক চরিত্রই যেন একটি লক্ষ্যের দিকে এগোয়। তবে প্রত্যেকটা চরিত্র থেকেই দর্শকের কিছু চাওয়ার থাকে সেটা যেন তারা পায় তাও খেয়াল রাখা জরুরি। একটি ভালো সিনেমার পূর্বশর্ত একটি ভালো গল্প। এক্ষেত্রে কমিটমেন্ট থাকাটা সবচেয়ে জরুরি।

ভালো গল্প হলে একটি ভালো সিনেমা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সেই সিনেমাকে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাজেটের। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে অনেকগুলো সিনেমা তৈরি হয়েছে। যেগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। কিন্তু ওই সিনেমাগুলো কাঙ্ক্ষিত দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। দেশের অধিকাংশ দর্শকই ওই চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী কিংবা পটভূমি কিছুই জানে না। এর পেছনে কী এমন কারণ রয়েছে যে, চলচ্চিত্রগুলো পুরস্কৃত হলো অথচ সিনেমা হল পায়নি কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায়। ওই চলচ্চিত্রগুলোর গল্প, চরিত্রের সমন্বয় সবই ঠিক ছিল। হয়তোবা বাজেট পর্যাপ্ত ছিল না। যে কারণে ছবিগুলোর প্রচার ঠিকঠাকভাবে হয়নি অথবা অভিনয়শিল্পীদের আর্থিক দাবি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ওই মৌলিক গল্পগুলোকে যদি প্রয়োজনীয় বাজেট দিয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কিংবা গ্রাম বা শহর সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য পরিপূর্ণ একটি সিনেমা হিসেবে উপস্থাপন ও প্রদর্শন করা যেত তাহলে অবশ্যই সোনায় সোহাগা হতো। কারণ দর্শক তখন বিনোদিত হতেন, লগ্নিকারী অর্থ তুলে নিতেন আর সিনেমাটিও পুরস্কৃত হতো।

বর্তমানে সিনেমাতে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা নিম্নগামী। একটি কথা হরহামেশাই প্রচারিত ও উচ্চারিত হয় যে, সিনেমায় প্রযোজকরা আসে গাড়ি দিয়ে আর যায় পায়ে হেঁটে। অর্থাৎ বিনিয়োগ করার পর প্রযোজকরা পথে বসে যাচ্ছে। যে কারণে দিনকে দিন চলচ্চিত্রে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে কেবল চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত থাকবে এমন প্রযোজকের সংখ্যা হাতেগোনা। নতুন যারা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করতে আসেন তারা এই প্রজেক্টকে পোর্টফোলিও হিসেবে গ্রহণ করে। যে কারণে একবার লোকসান হলে দ্বিতীয়বার বিনিয়োগ করার মানসিকতা তৈরি করেন না। পার্শ্ববর্তী দেশের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে এমন অনেক নজির পাব যে, বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ কেবল চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করার জন্য লিমিটেড কোম্পানি ওপেন করছে, যারা লাভ হোক ক্ষতি হোক বিনিয়োগ থেকে পিছপা হচ্ছে না। ফলে তাদের চলচ্চিত্র আজ বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়াচ্ছে। এদেশের অনেক খাতই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। শুধু প্রয়োজন আগ্রহ আর দূরদর্শিতা।

লেখক : চলচ্চিত্র ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads