• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পারিবারিক ও সামাজিক ভাঙন

শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তালাকের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি

সংগৃহতি ছবি

মতামত

ভিন্নমত

পারিবারিক ও সামাজিক ভাঙন

  • প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আরাফাত শাহীন

আমাদের সমাজব্যবস্থায় বেশ বড়সড় একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনোকিছুই ঠিক আগের মতো নেই। সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। এই পরিবর্তন কখনো আমাদের প্রভূত কল্যাণ বয়ে এনেছে আবার কখনো আমাদের নিজেদের ও সমাজের অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু পরিবর্তন থেমে নেই। অনাদিকাল থেকে শুরু হয়ে তা এখনো অবিরাম চলছে।

একক পরিবার গঠনের বেশকিছু সুবিধা ও অসুবিধা আমরা লক্ষ করেছি। আমরা দেখেছি, ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে যেমন একক পরিবার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তেমনি পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতিও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন প্রয়োজনের তাগিদে একসঙ্গে থাকতেন তখন তাদের মধ্যে যে ধরনের সম্প্রীতি বজায় ছিল আমাদের এই প্রজন্মের মধ্যে ঠিক তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখন আর দেখি না।

কিছুদিন পূর্বে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে তালাক নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে দেওয়া তথ্য অনুসারে দেশে বর্তমান সময়ে তালাকের প্রবণতা যে ভয়াবহ হারে বাড়ছে তাতে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এই হার আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তালাকের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি!

পরিবার যদি সুখের না হয় এবং তাতে স্থিতিশীলতা না থাকে তাহলে তা শিশুর জন্য মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে। পূর্বেই বলেছি, দিন দিন যে হারে তালাকের প্রবণতা বাড়ছে তা ভীতি জাগানিয়া। পরিবার ভেঙে যাওয়া একটা সামাজিক ব্যাধি। কতকগুলো পরিবারের সমন্বয়ে যেহেতু একটা সমাজ গঠিত হয় তাই পরিবারের এই ভাঙন সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপরও একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

পরিবার ভেঙে যাওয়া বা তালাকের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই কিন্তু নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হইনি আমরা। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে আমাদের কাছে পশ্চিমা জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করা সহজ হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করেছি তাদের উন্নত জীবনব্যবস্থার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। ফলে তাদের মতো হতে চেয়েছি এবং বহু পুরনো সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে জলাঞ্জলিও দিয়েছি। পরস্পরের প্রতি আমাদের কোনো বিশ্বাস নেই, নেই সামান্যতম দায়িত্বের মনোভাব। এই অবিশ্বাসের ফলেই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে পরিবার নামক বহু পুরনো একটা প্রতিষ্ঠান।

অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ে কাজের পরিধি এবং ব্যাপ্তি বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অফিসে কাজের সুবিধার জন্য নারী ও পুরুষকে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হয়। ফলে তাদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে বাধ্য। বিবাহিত নর-নারীর মধ্যে এই সম্পর্ক যখন প্রেম বা পরিণয়ে এসে দাঁড়ায় তখন আমরা তাকে পরকীয়া হিসেবে অভিহিত করে থাকি।

পরকীয়া আমাদের বর্তমান সময়ের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক অভিশাপ হিসেবে গণ্য। পরকীয়ার মতো জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের সমাজে শিক্ষার হার পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বহুলাংশে বেশি। পূর্বে নারীশিক্ষার হার ছিল খুবই কম। ফলে পুরুষ যদি নারীর ওপর অত্যাচারও করত সচেতনার অভাবে অসহায় নারী তার প্রতিবাদও করতে পারত না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। আইন সম্পর্কে নারীর সম্যক ধারণার ফলে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে একজন নারী আদালতে গিয়ে তালাকের আবেদন করছেন এবং স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ফলে ভেঙে পড়ছে একটা পরিবার।

তালাকের জন্য সবসময় যে নারী দায়ী এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় অনেক নারী বাধ্য হন এই পথ বেছে নিতে। সবসময় তালাকের জন্য নারী দায়ী না হলেও তালাকের ফলে যে ক্ষতি তা কিন্তু নারীকেই বহন করতে হয়! আমাদের সমাজ এখনো নারীর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় ওই পরিবারের শিশু সন্তান। শিশু বাবা কিংবা মা যার কাছেই থাকুক না কেন তার ক্ষতির কেনো কমতি হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পিতা-মাতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে এসব শিশু নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করে ফেলে। ফলে এরা সমাজ এবং দেশের জন্য এক সময় মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেয়।

তালাক কিংবা পরিবার ভেঙে যাওয়ার পেছনে পুরুষ কিংবা নারী যেই দায়ী থাকুক না কেন অবশ্যই এটা একটা গর্হিত কাজ। নিরুপায় না হলে কোনোমতেই এই পথে হাঁটা উচিত নয়। আমাদের সচেতন হতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের ফলে যে সমস্যার সূত্রপাত হয় তা সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলে যে ক্ষতির সূচনা হয় তা এক সময় পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য হলেও তালাকের মতো ভয়াবহতাকে আমাদের কমিয়ে আনতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads