• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
দুর্যোগ মোকাবেলায় ডেল্টা প্ল্যান

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ

আর্ট : রাকিব

মতামত

দুর্যোগ মোকাবেলায় ডেল্টা প্ল্যান

  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আ.ব.ম রবিউল ইসলাম

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতির আচরণ। বৃষ্টিপাতের ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাড়ছে লবণাক্ততা। আবহাওয়ায় এসেছে ব্যাপক মরুময়তা। শীতকালের পরিধি কমে এসেছে। ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ মোকাবেলায় ১০০ বছর মেয়াদি বদ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, দশ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার পর এবার গ্রহণ করেছে শতবছর মেয়াদি বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান ২১০০)। এতে দেশের ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা মোকাবেলায় বেশকিছু কর্মকৌশল ঠিক করা হয়েছে। এর আওতায় ২০৩১ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য ৮০টি প্রকল্পের সুপারিশ আছে। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প ও ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণাবিষয়ক প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার; বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, একসঙ্গে নয় বরং ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে বদ্বীপ এই মহাপরিকল্পনা। প্রথমে ২০৩১ সাল নাগাদ, এরপর ২০৫০ সাল নাগাদ, এরপর ২১০০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। পাঁচ বছর পর পর পুরো বদ্বীপ পরিকল্পনা তথ্য হালনাগাদ করবে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিবছর জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ২ শতাংশ জোগান দেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। বাকি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ আসবে বেসরকারি খাত থেকে। বদ্বীপ পরিকল্পনাটি তৈরিতে নেদারল্যান্ডস সরকার এরই মধ্যে ৮৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। আর বিশ্বব্যাংক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনাটি নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী ঐতিহাসিক দলিল। জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবররাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি একটি মাটি, মানুষ ও পানির সুব্যবহারের সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

৬৪টি জেলার মধ্যে কোন কোন জেলা কম ঝুঁকিতে আর কোন জেলা বেশি ঝুঁকিতে আছে, তার একটি বিশদ তালিকা করা হয়েছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়; যেটি আগে কখনো হয়নি। গাজীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও শেরপুর— এই সাতটি জেলা নদীবিধৌত না হওয়ায় এবং সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থান করায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কম। এছাড়া বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ জেলা ১৮টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন উপকূলীয় জেলা ১৯টি, হাওর ও আকস্মিক বন্যাকবলিত জেলা সাতটি, নদী অঞ্চল মোহনাবেষ্টিত জেলা ২৯টি, নগর এলাকার সাতটি এবং পার্বত্য জেলা তিনটি। সরকার চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকা ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। বদ্বীপ পরিকল্পনায় ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশলের বিষয়ে। এরপর পানি নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই নদী অঞ্চল, জলাভূমি সংরক্ষণ, আন্তঃদেশীয় নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে এই বদ্বীপ পরিকল্পনায়।

পরিকল্পনা কমিশন মনে করে, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে হলে অভিন্ন ৫৭ নদীর সন্তোষজনক অগ্রগতি অপরিহার্য এবং যে কোনো উদ্বেগ, অভিযোগ ও তথ্যবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে কৌশলগত সংলাপের বিকল্প নেই। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও প্রায়োগিক দক্ষতা দুটিই প্রয়োজন। বহুমুখী নদী অববাহিকা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এই দক্ষতার বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রধান ৩২টি নদীর পানির গুণগত মান বেশ খারাপ, যা গুরুতর পরিবেশগত অবনতির ঝুঁকিতে। এছাড়া দেশের ১৩ শতাংশ সরবরাহ করা পানিতে এখন আর্সেনিক সমস্যা আছে। আরো নতুন নতুন নদী শিল্পায়ন, কৃষি, যান্ত্রিকীকরণ, নগরায়ন, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা কমিশনের। তাই নদ-নদী রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়।

বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতার আলোকে কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ গঠন করবে ডেল্টা নলেজ ব্যাংক। তাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্য নিয়ে একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনা অনুমোদনের পর ডেল্টা আইন তৈরির কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া ডেল্টা তহবিল ও স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠনের কাজও একই সময় করা হবে। পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা করে স্বাদু পানির নদীর বিষয়ে বিশদভাবে বলা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী অঞ্চল ও মোহনা নগর অঞ্চল এবং আন্তঃদেশীয় নদী নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

উন্নত দেশের পথে হাঁটতে হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্য অর্জনে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এই পরিকল্পনার মূল প্রতিপাদ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির আড়াই শতাংশ অর্থ প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় করা হবে। বিনিয়োগের ৮০ ভাগ সরকারি তহবিল থেকে আসবে। ২০ ভাগ আসবে বেসরকারি খাত থেকে। আশা করা যায়, এই বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে উন্নত, সভ্য, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads