• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
খাদ্য নিরাপত্তা : আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে

প্রতীকী ছবি

মতামত

খাদ্য নিরাপত্তা : আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মূলত ভোক্তার ও উৎপাদকের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য আমদানি কিংবা রফতানি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বেসরকারি ও সরকারিভাবে খাদ্য আমদানির সুযোগ করে দেওয়ায় ধান ও গমচাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান ও গমচাষিদের স্বার্থ রক্ষা করতে প্রতিবছর বোরো ও আমন মৌসুমে চাল, ধান ও গম সংগ্রহ করে থাকে। অভ্যন্তরীণভাবে ধান, চাল ও গম সংগ্রহের উদ্দেশ্য দুটি। একটি হলো উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষা করা, আর অন্যটি হলো সরকারের আপৎকালীন খাদ্য মজুত গড়ে তোলা। সরকারকে যেমন উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়, তেমনি ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যশস্য আমদানিও করতে হয়। এ সমীকরণটি খুবই জটিল। যেমন প্রধান খাদ্যের জোগান আসে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ধান থেকে। গত বছর আগাম বন্যা ও নেকব্লাস্ট রোগের কারণে ধান উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে। চালের বাজার হু হু করে বাড়তে থাকে, যা সামাল দিতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ায় সরকারি-বেসরকারি দুই খাতে চাল আমদানি বেড়ে যায়। ভেঙে যায় চাল আমদানির অতীত সব রেকর্ড। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও)-র মতে, স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মধ্যে চাল ও গম আমদানিতে গত বছরই শীর্ষে এসেছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে যেখানে ৩০-৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করত বাংলাদেশ, ২০১৬ সালে তা অনেক কমে আসে। হঠাৎ উৎপাদন কমায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি হয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৮ লাখ ২৩ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়, যা বৃদ্ধি পেয়ে গত ১১ জুন এসে দাঁড়ায় ৯৯ লাখ ১২ হাজার টনে। এ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, নির্বাচনের আগে এই আমদানি বাড়ার প্রভাব অন্যরকম হতে পারে। তিনি মনে করেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকা পাচার করতে পারে, যা খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে ৯৯ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে, যা বিশ্বাস করাও কঠিন। শুধু চাল গমই নয়- এর বাইরে লবণ, চিনি, তেলও প্রচুর পরিমাণে আমদানি হয়েছে। আরো লবণ আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে মর্মেও জানা গেছে। বাড়তি চাল গম আমদানির কারণে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন মোটা ও চিকন দুই ধরনের ধানের বাজারমূল্য তুলনামূলক কম। সরকার এ বোরো মৌসুমে ৯ লাখ টন চাল ও দেড় লাখ টন ধান অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের ঘোষণা দেয়, যার আওতায় চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। ইতোমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ধারণা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে চাল সংগ্রহ শেষ হলেই ধানের বাজারদর আরো কমে আসবে। এতে ধানচাষিরা আর্থিকভাবে আরো ক্ষতির মুখে পড়বেন। এ অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয়কে আরো ৪-৫ লাখ টন বাড়তি চাল সংগ্রহ করা উচিত।

এ দেশের চাষিদের বড় অবলম্বন হচ্ছে উৎপাদিত ধান। কৃষি উৎপাদনের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, কৃষি শ্রমিকের অভাবের কারণে উৎপাদন খরচ অনেকটাই বেড়ে গেছে। যেখানে সরকার ঘোষিত ধানের মূল্য প্রতিমণ ১০৪০ টাকা, সেখানে এখন চাষিদের ৭০০ থেকে ৭১০ টাকায় ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। চলছে আমন মৌসুম। এ মৌসুমে আমন চাষাবাদে কৃষি শ্রমিক ও কৃষি উপকরণ বাড়তি দামে কিনতে হবে, সেখানে যদি মাত্র ৭১০ টাকা মণে ধান বিক্রি করতে হয়, তাহলে ধানচাষিদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এভাবে দেশের কৃষককুলের আর্থিক সক্ষমতা দিনে দিনে কমে আসছে। এ অবস্থায় ধানচাষিদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সরকার চলতি বছরে অভ্যন্তরীণভাবে দেড় লাখ টন ধান সংগ্রহের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত এক ছটাক ধানও কেনা হয়নি। সরকার ধান সংগ্রহ না করে বরং ধানের বরাদ্দকে চালে রূপান্তর করে চালই কিনেছে। প্রকৃত অর্থে কৃষকের স্বার্থের কথা যেভাবে উচ্চারিত হয়, সেভাবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। ফলে বরাবরই চাষির স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে যায়।

যদিও সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটে চাল আমদানির ওপর পুনরায় শুল্ক ধার্য করে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ সঠিক ও সময়োচিত, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও ভোক্তার কষ্ট যাতে না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয় সত্য। কিন্তু উৎপাদকের স্বার্থ বিবেচনায় না নিলে উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এটাও তেমনি সত্য। এজন্যই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মনে করে, যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অন্তত ৬০ দিনের খাদ্যশস্য সরকারিভাবে মজুত রাখা বাঞ্ছনীয়। এ হিসাবে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর একদিনের খাবার লাগে প্রায় সাড়ে ৪৫ হাজার টন। আর ৬০ দিনের খাবার লাগে প্রায় সাড়ে ২৭ লাখ টন। অথচ আমাদের দেশে সরকারিভাবে ১৮-১৯ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রাখার মতো খাদ্যগুদাম রয়েছে।

জলবায়ুজনিত অভিঘাত খরা, আগাম বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। ফলে যে কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল হানি হলে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এজন্য সরকারিভাবে আরো ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত উপযোগী খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা জরুরি। অর্থাৎ আমাদের আপৎকালীন খাদ্যশস্য ৬০ দিনের জন্য মজুত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন বৃহৎ গোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়।

উৎপাদক আর ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। এজন্য দেশীয় শিল্প কলকারখানাগুলোকে চালু রেখে দেশীয় পণ্য বিপণনের ব্যবস্থা নিতে হবে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার উৎপাদকের স্বার্থরক্ষায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে, এটাই আপামর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads