• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
জ্ঞানের প্রতিপক্ষ এমসিকিউ

এমসিকিউ ভালো না মন্দ এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে

আর্ট : রাকিব

মতামত

জ্ঞানের প্রতিপক্ষ এমসিকিউ

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) পদ্ধতি পরিহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটা বেশ একটা  ভালো খবর। এতে প্রকৃত মেধাবী ছেলেমেয়েরা ভর্তির সুযোগ পাবে। অন্তত পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে, যারা পঠিত বিষয় ভালো করে বুঝেছে ও জেনেছে, তারাই এই পরীক্ষায় এগিয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে যারা গাইড বই ও কোচিংনির্ভর, তারা খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। তাদের অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো পরীক্ষা দিতেই আসবে না। বাংলাদেশের খবরের কাছে একজন উদ্বিগ্ন অভিভাবক বলেন, বুঝতে পারছি না এখন কী হবে! ছেলেকে এতদিন ভর্তি কোচিং করিয়েছি। কোচিং সেন্টারে তো এমসিকিউ-ই পড়ানো হয়। এখন কী হবে! আসলে কী হবে সেটা জানে ওই ছেলেমেয়েরাই, যারা এইচএসসিতে দুই বছর পড়েছে। আমাদের দেশে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন লেখাপড়া চলছে অনেক দিন থেকেই। পাঠ্যবই ছুঁয়েও দেখেনি, শুনেছি, এমন ছেলেমেয়ের অনেকে এ প্লাস পেয়ে বসে আছে সৃজনশীল আর এমসিকিউয়ের বদৌলতে। জবিতে এমসিকিউ উঠিয়ে দেওয়ার সংবাদ জানতে পেরে অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বলেছেন, এই পদ্ধতি যদি সফল হয়, তাহলে তারাও এটা চালু করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অবশ্য এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করার পক্ষপাতী নন।

এমসিকিউ ভালো না মন্দ এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। বিশেষ করে যারা গাইড বইয়ের ব্যবসা ফেঁদে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তারা এর ভালো দিকটাই বেশি করে দেখতে চাইবেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিনিয়োগের প্রশ্ন। আজ যদি ভর্তি পরীক্ষাসহ মেধা যাচাইয়ের সব পরীক্ষায় এমসিকিউ তুলে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের পাকা ধানে মই দেওয়া হবে। এমন নয় যে, তাদের গাইড ব্যবসা উঠে যাবে। তা না গেলেও, তাদের নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে। সেই যে কবে প্লেট-ফর্মা বানিয়ে রেখেছেন, সেটা দিয়েই বছর বছর তারা নতুন বই করেন। দরকারমতো নতুন দুয়েকটি ফর্মা অ্যাড-অলটারনেশন করে দিলেই কাজ হয়ে যায়। বছর বছর খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হয় না। এখন সিস্টেম বদলে গেলে ন্যারেটিভ কোয়েশ্চেন বানাতে হবে। উত্তর লিখতে হবে। এজন্য ভাড়া করা লেখক জাতীয় লোকদের নতুন করে টাকা দিতে হবে। প্রুফ দেখাতে হবে। এখানেও টাকা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন ভর্তি পরীক্ষায় এমসিকিউ উঠিয়ে দিতে যাচ্ছে, তখন অন্যেরাও এই পথ ধরল বলে। এমসিকিউয়ের সঙ্গে যদি সৃজনশীলও যায়, তাহলে তো সাড়ে সব্বনাশ। সৃজনশীল নিয়েও প্রচুর বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে যারা সৃজনশীল পড়ান, যারা প্রশ্ন করেন এবং পড়ে ও পরীক্ষা দেয়, এদের বেশিরভাগই সৃজনশীল নয়। পদ্ধতিটাই শুনেছি তাদের মাথায় ঢোকে না। সৃজনশীলতার মানেও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। মজার ব্যাপার হলো যারা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন, অভিযোগ রয়েছে, তাদের অধিকাংশই গাইড বই থেকে টুকলিফাই করেন। নিজের সেই ক্ষেমতা নেই যে একখানা ভালো উদ্দীপক বানিয়ে আনকোরা প্রশ্ন করবেন। আর গাইড বইয়ের বাইরে থেকে একেবার নতুন প্রশ্ন হলে, তাদের অনেকে যেমন চোখে সর্ষে ফুল দেখবে, তেমনি যারা খাতা দেখেন তাদেরও কেউ কেউ মাথার চুল ছিঁড়বেন। উত্তর ঠিক হয়েছে কি-না, সেটা তারা বুঝবেন কেমন করে! এমসিকিউ ও সৃজনশীল উঠে যাওয়ার এগুলো হচ্ছে এক ধরনের ডিজঅ্যাডভান্টেজ।

আর এমসিকিউ এবং সৃজনশীলতার যেমন অনেক সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন সিস্টেম জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে গত  শতাব্দীর মধ্যভাগে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির প্রফেসর ইএল টর্নাডিক শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের মেধা যাচাইয়ের জন্য এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক অধ্যাপক বেঞ্জামিন ডি উড। পরে কম্পিউটারে এমসিকিউ পরীক্ষার উত্তর মূল্যায়নের পদ্ধতিও বেরিয়ে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্যে উদ্ভাবিত হলেও এই এমসিকিউ খুব সফলভাবে ব্যবহূত হচ্ছে বিভিন্ন জরিপ, ভোট প্রদান, কম্পিউটার অ্যাকটিভিটি প্রভৃতি কাজে। বাজার জরিপ করতে বড় কোম্পানিগুলো হামেশাই এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে। কিন্তু শিক্ষার্থীর বা চাকরিপ্রার্থীদের মেধা যাচাইয়ে এই সিস্টেম যথার্থ প্রমাণিত হয়নি। বরং কেউ কেউ মেধা যাচাইয়ের এই পদ্ধতিকে উদ্ভট ও জ্ঞানবিমুখ বলে নিন্দা করেন। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় দেখলাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সখেদে লেখেন, এই উচ্চ ডিগ্রিধারী অশিক্ষিতদের দিয়ে আমরা কী করব! ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থী ডিগ্রিধারী পরীক্ষার্থীদের খাতায় বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর লেখার ছিরি দেখে তার এই দিব্যদর্শন হয়েছে। কী বাংলা কী  ইংরেজি, কোনোটারই বানান ও বাক্যের কোনো ছিরিছাদ ছিল না অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর। এ জন্য অবশ্য সব দায়  এমসিকিউ অথবা তথাকথিত সৃজনশীল লেখাপড়ার— এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। দায়ী আরো অনেক কিছুই। শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উদ্ধত দুর্নীতি এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, একালে যারা শিক্ষকতা করেন, তাদের অধিকাংশের প্রধান গুণ নাকি দলাদলি করতে পারা এবং অবিদ্যা। শিক্ষা বিভাগের কর্তারা আকারে-প্রকারে শিখিয়েছেন যে, লেখাপড়া দিয়ে কিছু হয় না। দরকার তেল-তদবিরের যোগ্যতা। মাখো তেল, ফেলো কড়ি, হাঁকাও গাড়ি, বানাও বাড়ি।- এই তাদের ফিলোসফি। বরাভয় নিয়ে এই শ্রেণির পাশে রয়েছে ক্ষমতাবানরা, টাকা তো তাদেরও দরকার। যতদূর মনে পড়ে বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ চালু হয় এইচএম এরশাদের আমলে। কাজী জাফর শিক্ষামন্ত্রীর চাকরি পাওয়ার পর তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখনই তিনি নোট ও গাইড বইও নিষিদ্ধ করেন। উদ্দেশ্য খুবই মহৎ ছিল। ছেলেমেয়েরা পাঠ্যবই পড়বে, ক্লাসে লেখাপড়া হবে। পাঠ্যবই থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন হবে। যারা বুঝে-শুনে বই পড়বে, যেসব স্কুলে ভালো লেখাপড়া হবে সেইসব ছেলেমেয়ে ঠিক ঠিক উত্তর বাছাই করতে পারবে সহজেই। যারা সারা বছর পড়বে না, তারা পরীক্ষার হলে গিয়ে খাতা বন্ধ করে তাকিতুকি করবে। নোট-গাইডের বালাই থাকবে না। কিন্তু হলো তার উল্টো। অনতিবিলম্বে দেখা গেল নোট-গাইডের ব্যবসায়ীরা আন্দোলন ও দেন-দরবার শুরু করে দিয়েছেন। একশ্রেণির শিক্ষক ও অভিভাবকও যোগ দিলেন এই কাফেলায়। চাপের মুখে সরকার বলল, না, নোট-গাইড আর সিদ্ধ করা হবে না। তার বদলে পাঁচশ প্রশ্নের প্রশ্নব্যাংক প্রকাশ করা যাবে। এই প্রশ্নব্যাংক বানিয়ে দেবে শিক্ষা বিভাগ। ব্যস; নোট-গাইড মোড়ক বদলে হয়ে গেল প্রশ্নব্যাংক। আর এখন আইনত নোট-গাইড নিষিদ্ধ। কার্যত আছে সবখানে। মাস্টার সাহেবরা এই খাতে শোনা যায় ভালো টাকা রোজগার করেন। নোট-গাইডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো আধুনিক ব্যবস্থা, যার নাম কোচিং। ব্যবসাটা এখন অনলাইনেও আছে।

এমসিকিউকে যারা জ্ঞানের বিপরীত মনে করেন, তারা বলেন, এই পদ্ধতি লিটল ইনফরমড সোসাইটি তৈরি করছে, নলেজবল নয়। ইনফরমেশন বা ডাটা কখনোই জ্ঞান নয়, হতে পারে এটা জ্ঞানের শুরু, যদি ব্যক্তি জ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। ধরা যাক চাকরির পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন এলো, ‘তোমারে যে দিয়েছিনু, সে তোমারই দান—/গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত  করেছ আমায়/হে বন্ধু বিদায়।’ — কবিতাংশটি রবীন্দ্রনাথের কোন বই থেকে নেওয়া হয়েছে? উত্তরের জায়গায় কয়েকটি অপশন দেওয়া হলো সঠিকটি বেছে নেওয়ার জন্য। যেসব ছেলেমেয়ে চাকরির গাইড মুখস্থ করেছে, তারা চটজলদি টিক চিহ্ন মেরে দিল, শেষের কবিতা। অথচ দেখা গেল, সঠিক জবাব দেওয়া পরীক্ষাদের অনেকে শেষের কবিতা বইটি চোখেও দেখেনি। এটি কবিতা না উপন্যাস, তাও জানে না। কবিতাটি কেন, কে ব্যবহার করেছেন তাও জানে না। এরকম ইনফরমেশনকে কি জ্ঞান বলা যাবে, না বলা উচিত? এমসিকিউয়ের বদৌলতে এরকম লিটল ইনফরমডরাই তো বহু ক্ষেত্রে চাকরি-বাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে যে ছেলে বা মেয়েটি শেষের কবিতা পড়েছে, এর বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে ভেবেছে, সে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে ওই লাইন দুটি মনে করতে পারেনি। শেষের কবিতা বিষয়ে যার গোল্লা পাওয়ার কথা, সে পাচ্ছে ফুল মার্ক, আর যার ফুল মার্ক পাওয়ার কথা, সে পাচ্ছে জিরো। মেধা যাচাইয়ের এর চাইতে নিকৃষ্ট ব্যবস্থা আর কী হতে পারে!

এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যারা বুঝতে চান তারা এটুকুতেই বুঝবেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এমসিকিউ উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুকরণীয় কাজ করেছে। আশা করি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই পথ অনুসরণ করবে। পাবলিক পরীক্ষা এবং চাকরি-বাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই সিস্টেমটাকে গুডবাই বলা উচিত। তাহলে আশা করা যায় প্রকৃত যোগ্য ও দক্ষ ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। এতে লেখাপড়ারও মানোন্নয়ন ঘটবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads