• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
ভাগ্যাহত বীর ও দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজ

বাংলা বিহার উডিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা

মতামত

ভাগ্যাহত বীর ও দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজ

  • প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা

বাংলা বিহার উডিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭২৭ মতান্তরে ১৭৩২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। বাংলার এই ভাগ্যাহত শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন দেশহিতৈষী একজন শাসক। তার কর্মজীবন বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা উচিত। কেননা তার দেশপ্রেম নতুন সমাজ গঠনে তরুণদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথভাবে উভয় বাংলার কোথাও পালিত হতে দেখা যায় না। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। এখনো দেশ ও জাতির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে নব্য মীর জাফররা ওঁৎ পেতে আছে। তাদের থেকে সাবধান হতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে মীর জাফরদেরকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার ইতিহাসে এক ভাগ্যাহত বীর ও দেশপ্রেমিক। আজ থেকে ২৬১ বছর আগে ২৩ জুন হুগলী জেলার পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতিসহ আমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রের কারণে ইংরেজদের কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজো শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গেই স্মরণ করে থাকে। 

মূলত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসেন। নবাবের খালা ঘষেটি বেগম ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলান। সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ, ধনকুবের জগৎ শেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ধূর্ত ইংরেজরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে চন্দননগরের ফরাসিদের দুর্গ দখল করে নেয়। এরপর ১৭৫৭ সালের ১৭ জুন ক্লাইভ কাটোয়ায় অবস্থান নেয়। নবাব ২২ জুন ইংরেজদের আগেই পলাশী পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের পরাজয় ঘটে এবং বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ভাগীরথীর বুকে অস্তমিত হয়। এরপর ইংরেজরা নবাবের চরিত্রে অন্ধকূপ হত্যা, লাম্পট্য নানাভাবে কলঙ্ক লেপন করতে থাকে। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্টও তৈরি করা হয়। তার নাম ছিল ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’। পরবর্তী সময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ৩ জুলাই, ১৯৪০ সালে ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে ইংরেজদের বাধ্য করে ওই হলওয়ের মনুমেন্ট তুলে নিতে। পরবর্তী সময়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে ২৩ জুন  প্রথম পলাশী দিবস উদযাপিত হয়েছিল কলকাতায়। সঙ্গে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মাওলানা আকরম খাঁ। এ ব্যাপারে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন ‘দৈনিক আজাদ’ এবং ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ১৯৩৯ সালের জুনে। বিবৃতিতে কবি নজরুল বলেন, ‘মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে কলিকাতায় সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশির বন্ধন-শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজের জীবনস্মৃতি হইতে যেন আমরা অনুপ্রাণিত হই। ইহাই আমার  প্রার্থনা।’ এ  প্রার্থনা বিফলে যায়নি। পলাশী দিবস প্রতিবছরই আসে। কখনো সরবে, কখনো নীরবে। এ কথা সত্য, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর ও দেশপ্রেমিক।

নবাব সিরাজের শাসনকাল এক বছর হলেও তিনি ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে এক অপরাজেয় দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। মুর্শিদাবাদ থেকে সামান্য দক্ষিণে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে প্রাচীরবেষ্টিত সমাধি ভবনে চিরনিদ্রায় শায়িত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পাশে তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, আলিবর্দী খানের কবরও একই সমাধি ভবনে। আজো ভাগীরথীর পানি কল কল শব্দে বয়ে যায় সমাধি ভবনের পাশ দিয়ে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস নতুন প্রজন্মের শিক্ষা গ্রহণের ইতিহাস। এ শিক্ষা প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশি-বিদেশি দুষ্ট শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শিক্ষা।

ভারতে তথা সমগ্র বাংলায় কয়েক শতাব্দীর নবাব-রাজাদের শাসন যে অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, তা আলীবর্দী খাঁর সীমাহীন উদারতা এবং সিরাজউদ্দৌলার মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রতিফল হিসেবে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিনষ্ট হয়েছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির অঙ্ক এত বিরাট যে, তা পুষিয়ে নিতেই যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে আজো সংগ্রাম করে চলেছে বাংলার মানুষ। পশ্চাতে কাজ করছে এক ইতিহাসখ্যাত নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্ভীক দেশপ্রেম।

লেখক : নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবম বংশধর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads