• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
শিশুর আইনগত অধিকারের অপ্রাপ্যতা

মেয়েটিকে নিয়ে শুরু হয় এই নারীর কষ্টের পথচলা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

শিশুর আইনগত অধিকারের অপ্রাপ্যতা

  • প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সাঈদ চৌধুরী

প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনার সম্মুখীন হই আমরা। এখন নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছি। অনেক ঘটনাই শুনি না বা শুনতে চাই না। এর পেছনেও রয়েছে নিজেকে ভালো রাখার প্রয়াস। কিন্তু এ ধরনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে গিয়ে যে আমাদের অধিকারগুলোই হারাচ্ছি, তা কি অনুভব করছি কখনো? কিছু কিছু ব্যাপার এড়ানো যায় না। এটা একটা দায়বদ্ধতারই জায়গা। খুব কাছের একজন মানুষের আত্মীয়ের একটি সমস্যার কথা শুনতে গিয়ে হাহাকার মেশানো নিঃশ্বাস ফেলতে হলো আবার। সুন্দর সংসারে ফুটফুটে একটি মেয়েসন্তান আছে এই দম্পতির।

যেদিন বিয়ে হয় এই দম্পতির, সেদিন সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। ধুমধাম বিয়ের পর সংসার শুরু, তারপর সুন্দর একটি কন্যাসন্তান। আস্তে আস্তে যখন বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে দম্পতির মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলো, তখনই কেবল জানা গেল ছেলেটি নেশায় আসক্ত। ঘরে কন্যাসন্তান আর প্রতিদিনই সে নেশা করে ঘরে ফেরে। স্ত্রী বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। একসময় ডিভোর্স দিতেও বাধ্য হয় সে। ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে আসার পর একজন নারীর যে অপ্রাপ্যতা যদি সে আইনের দ্বারস্থ না হয়, সে ক্ষেত্রে অবস্থা কতটা করুণ হয় তা আমরা বুঝতেই পারি না। মেয়েটিকে নিয়ে শুরু হয় এই নারীর কষ্টের পথচলা।

আইন আছে ভরণপোষণের, কিন্তু কতজন মানুষ তা পেয়ে থাকে সেটা দেখার বিষয়। আইনের দ্বারস্থ হলেই কেবল আইনের সুবিধা, না হলে তা চাপা পড়ে যায়। একা চলতে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে সে যখন হোঁচট খেতে থাকে, তখনো সে প্রচণ্ড রকম ধৈর্য নিয়ে পথ চলে। ফুটফুটে বাচ্চাটি বাবার অভাব বোধ করে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে দিন কাটাতে থাকে।

নারীরা আমাদের সমাজে অসহায় বলেই পরিবারের চাপে আবার বিয়ে করতে বাধ্য হয় অনেক সময়। এই নারীর বেলায়ও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আবার বিয়ে হলো ধুমধাম করে। সংসার শুরু হলো নতুন স্বপ্ন নিয়ে। নতুন স্বামীর ঘরে নতুন নতুন সব মানুষ। এই নারীর আগে বিয়ে হয়েছিল বলে এমনিতেই কিছু মানুষের বাঁকা চাহনি প্রথম দিন থেকেই শুরু। বিশেষ করে পাড়াপড়শি নারীরাই নারীদের বেশি কটাক্ষ করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আস্তে আস্তে বোঝায় পরিণত হয়ে উঠতে থাকল বাচ্চা মেয়েটি। নিষ্পাপ মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়ির সবাই আড়চোখে দেখতে লাগল। মায়ের কাছে ছোট্ট মেয়েটিই যেন এখন সবচেয়ে দূরের মানুষ!

এই অসহায় মায়েদের আসলে কীইবা করার থাকে! অসহনীয় যন্ত্রণায় একসময় মায়ের বিছানা থেকেও শিশুটিকে সরে আসতে হয়। তারপর নতুন শাশুড়ির বার বার একটি কথাই মনে করিয়ে দেওয়ায় এক সময় মা নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় শিশুটিকে আর তার কাছে রাখবে না। শিশুটিকে একদিন তার নানুবাড়িতে রেখে বলে আসে- মা, তুই কয়েকদিন বেড়িয়ে তারপর আবার আমার কাছে আসিস। মেয়েটিও বুঝতে পারে তার মায়ের বুকে আর ঘুমানো হবে না কখনো।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শিশুটি মাকে বিদায় দেয়। শিশুটির বাবা নেশা করে করে জীবনের সব হারিয়ে শিশুটির খরচ দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে নিঃস্ব বলে শোনা যায়, আর এদিকে মায়ের আদরবঞ্চিত শিশুটি পড়াশোনা করতে থাকে নিভৃতে।

এ ধরনের শিশুর সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। ঢাকায় ব্রেকআপের সংখ্যা আরো বেশি। সিঙ্গেল মাদার অথবা সিঙ্গেল ফাদার শব্দটি যেদিন থেকে অভিধানে ঢুকেছে, সেদিন থেকেই আরো একটা সমস্যার নাম সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো ‘লোনলি চিলড্রেন’, যে বিষয়টি এখনো না-জানা। তবু লোনলি চিলড্রেনের দায়িত্বও একদিন এ সমাজকে বইতে হবে।

আইনগত অধিকারবলে শিশুটি বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখলেও তা থেকে যেমন সে বঞ্চিত, তেমনি বঞ্চিত মায়ের নতুন শ্বশুরবাড়ির অধিকার পাওয়া থেকেও। শিশুটির মায়ের নতুন শিশু এসেছে আবার। মায়ের বুক আবার শিশুতে পরিপূর্ণ; কিন্তু এই শিশুটি? মায়ের আদর পাওয়ার অধিকার এ শিশুটিও রাখে। যদি অধিকার রেখেই থাকে তবে শিশুটির মায়ের কাছে থাকার অধিকার আইনগতভাবেই থাকা উচিত বলে মনে করি। আইন সংশোধন করে হলেও নতুনভাবে এ বিষয়টি আইনে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিয়ের পর কোনো নারী চাইলে তার আগের সন্তানকেও সে সঙ্গে রাখতে পারবে এবং এটা তার অন্যান্য অধিকারের মতোই অধিকার।

যদি এই শিশুগুলো এভাবে বঞ্চিত হতে থাকে তবে হতাশ মানুষের সংখ্যা বাড়বে, পরিবার বিচ্ছিন্নতা বাড়বে, বাড়বে অস্থিরতাও। একসময় এ শিশুটি পরিবারপ্রথাকে ঘৃণা করতে করতে ভাবতেই পারে একাকী জীবনই ভালো এবং তখনই তো পরিবারপ্রথা বিলীনের প্রশ্ন এসে যাবে। প্রতিটি অধিকারবঞ্চনাই একেকটি অপরাধপ্রবণতা বাড়ার কারণ। শিশুদের অধিকার রক্ষায় এই আইনটি কীভাবে করলে আরো সুরক্ষিত আইন হবে, তা ভাবার এখনই সময়।

লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads