• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আজকের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানবিমুখ

প্রতীকী ছবি

মতামত

আজকের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানবিমুখ

  • আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমি অকিঞ্চিৎকর মানুষ। শিক্ষা, শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীরা আগের মতো উপস্থিত থাকছে না, সেই ভাবনা থেকে আজকের লেখা। প্রাথমিকে পড়ার সময় সেরা উপস্থিতির জন্য ইউনিসেফের একটি পেন্সিল পেয়েছিলাম আমি স্কুল থেকে। ৪৩ বছর আগের পাওয়া সেই পেন্সিলটি আজো সযত্নে রেখে দিয়েছি। সেই স্কুল, সেই স্কুলের শিক্ষকদের আজো মনে রেখেছি। হঠাৎ দেখা হলে প্রাণভরে কথা বলি। শ্রদ্ধা করি। তাদের শাসন, স্নেহ আজো চলার পথকে অনুপ্রেরণা জোগায়। সাহস জোগায়। টিফিনে ইউনিসেফের বিস্কুট, ছাতু দেওয়া হতো। মা-বাবার দেওয়া দশ পয়সা দিয়ে কোনো কোনো দিন টিফিন করেছি। স্কুল ইউনিফরম ছিল না, আজকের মতো দামি ব্যাগ, পোশাক, জুতা কিছুই আমরা পাইনি। পুরনো সেন্ডেল, পুরনো পোশাক আর পুরনো বই— এই ছিল আমাদের সবকিছু। যানবাহনে চড়ে কিংবা মা-বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, দামি টিফিন খাওয়া— এসব কিছু আমরা পাইনি। মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার এক বিত্তবান এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে এক জোড়া বাটা কোম্পানির জুতা উপহার দিয়েছিল। সেটিই আমার জীবনে প্রথম জুতা পরা। এখনকার প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এসব বিশ্বাসই করতে চাইবে না।

প্রসঙ্গটা ছিল শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানবিমুখ কেন। বিষয়টি নিয়ে নানা ব্যক্তি, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানতে পেরেছি প্রাথমিকে এখন গড় উপস্থিতি ৯০ শতাংশের মতো। হয়তো আরো বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষা অফিসাররা নিয়মিত মনিটরিং করেন। মফস্বলের অনেক স্কুলে উপবৃত্তির ব্যবস্থা আছে। বিনা পয়সায় এখন সরকারি বই পায় শিক্ষার্থীরা। এছাড়া কিশোর বয়সে স্কুলে যাওয়া আনন্দদায়ক উপাদান। এই বয়সটা স্বচ্ছ, সহজ, আনন্দময়। প্রাথমিকে তাই শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায়। কিন্তু বিবিধ কারণে কিছু ঝরেও পড়ে।

উচ্চ বিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেসব কাগজে কলমে। বাস্তবে মফস্বল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উপস্থিতি খুবই নাজুক। সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান নাকি এই ৭৫ শতাংশ উপস্থিতির কথা প্রচারই করে না। শিক্ষার্থীরা পাস করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চলে যায়, কিন্তু এই ৭৫ শতাংশের বিধি জানতে পারে না। জানতে পেরেছি ফরম পূরণের সময় কর্তৃপক্ষ ফরমে নিজেরাই লিখে দেয় যে, সেই ছাত্রের উপস্থিতি ৭৫ শতাংশ। উচ্চ বিদ্যালয়ে  এসব বিষয়ে কিছু মনিটরিং থাকলেও কলেজ পর্যায়ে কোনো মনিটরিং নেই বলা যায়। স্থানীয় ইউএনও বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সদস্যরা কালেভদ্রে পরিদর্শনে আসেন। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের এ বিষয়ে মনিটরিং করার কথা থাকলেও নিবেদিত কিছু প্রধান তা করেন। আর শিক্ষার্থীরা এখন স্কুল-কলেজে উপস্থিত থাকার চেয়ে কোচিং, টিউশনিতে সময় দেওয়াকে বেশি পছন্দ করে। এরও কারণ বহুবিধ, বিশেষত শিক্ষা পদ্ধতি অন্যতম।

একটি কলেজের একজন শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। বেসরকারি স্কুল পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে নবম-দশম শ্রেণিতে মাসিক বেতন দিতে হয় ৯০ টাকা। নিচের ক্লাসে আরো কম। সরকারি স্কুলে আরো কম। আর একটি কোচিং সেন্টারের একজন শিক্ষার্থীর মাসিক খরচ ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা। আপনার কোনো সন্তানকে বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে পড়াবেন, তাহলে আপনাকে গুনে গুনে সেই শিক্ষককে ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা দিতে হবে। অবশ্য রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে আরো বেশি। বর্তমানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের খরচের চেয়ে কোচিং-টিউশনির খরচ বেড়ে গেছে। তারপরও শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে ক্লাস করার চেয়ে কোচিং-টিউশনিতে ক্লাস করতে আগ্রহী বেশি। এর উত্তর খুঁজতে বেশকিছু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। ভয়ে ভয়ে কিছু শিক্ষার্থী বলেছেন, প্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষা, বিভিন্ন ছুটি, নানা অনুষ্ঠান ইত্যাদি কারণে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। কিন্তু কোচিং-প্রাইভেটে এসব বলতে গেলে নাই। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা বলছেন, আমরা তো নিয়মিত ক্লাস নিতেই চাই। ছাত্ররা স্কুল-কলেজ চলাকালীন কোচিং-প্রাইভেটে ক্লাস করে। এ ছাড়া মফস্বল পর্যায়ে নানা কারণে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না। শুধু পরীক্ষার সময়ে এসে পরীক্ষা দেয়। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষক, স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারেননি। তাছাড়া কিছু অসাধু শিক্ষক আছেন, যারা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট, কোচিংকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না আসা যে একটি অপরাধ এবং এর জন্য যে জবাবদিহি করতে হয়— এ বিষয়টি উঠে গেছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। অনেক বেসরকারি কলেজে দুপুর ১২টার পর শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যায়।

বেসরকারি-সরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে এখন সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ কলেজে শিক্ষার্থীরা ভুলেও লাইব্রেরিতে বসেন না। পর্যাপ্ত পেপার, ম্যাগাজিন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই। বার্ষিক খেলাধুলার জন্য ফি নেওয়া হলেও বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে তা হয় না। খেলাধুলার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। জাতীয় কোনো দিবস এলে দু-একদিনের প্রশিক্ষণ শেষে দল নিয়ে অনুষ্ঠানে দৌড় দেন তারা।

মাঝে মাঝে এলাকার অনেক প্রতিষ্ঠানে যাই, কথা বলি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে। শিক্ষকরা বলেন, অধিক সময় ধরে ছাত্ররা এখন আর ক্লাস করতে চায় না। টিফিনের পর তাই অনেকেই পালিয়ে যায়। আমিও নিজে দেখেছি টিফিনের সময় অনেক শিক্ষার্থী দেয়াল টপকে চলে যায়। শিক্ষকরা বলেন, এখন আমরা ছাত্রদের কঠোরভাবে শাসন করতে পারি না। নিষেধাজ্ঞা আছে। মফস্বলে এখন ৬-৭টি করে বেসরকারি স্কুল-কলেজ। ফলে শিক্ষার্থী সঙ্কট দেখা দিয়েছে প্রায় প্রতিষ্ঠানে। মানুষ গড়ার এসব কারিগরকে এখন শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয়। শিক্ষার্থীদের সত্য-মিথ্যা নানা প্রলভন দিয়ে থাকেন তারা। কী লজ্জার কথা! আবার মানুষ গড়ার কারিগরদের রাস্তায় আন্দোলন করতে হয় কিছু ন্যায্য দাবিতে। দাবিগুলো মেনে নিতে হবে এ কথা বলছি না। তাদের বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, ঈদ উৎসব ভাতা, ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, বৈশাখী ভাতা— আন্দোলনের বিষয় হবে ভাবতেও পারি না। শিক্ষকরা যখন আন্দোলন করছেন, অনশন করছেন, তখন তাদের ছাত্রছাত্রী, সন্তানরা টিভিতে, পেপার-পত্রিকায় সেসব দেখছে। এসব নিয়ে তাদের মনেও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। শিক্ষকরাও সন্তানদের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছেন। এই মানসিক অবস্থান থেকে শিক্ষকদের পক্ষে ভালো পাঠদান করা কি সম্ভব?

আগেই বলেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সহশিক্ষা কার্যক্রম হারিয়ে যাচ্ছে। বার্ষিক খেলাধুলা, আন্তঃস্কুল-কলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা, অভ্যন্তরীণ সাহিত্য, সঙ্গীত, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় না। কেন হয় না— সেই প্রশ্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবিয়েও তোলে কি-না সন্দেহ। ফলে শিক্ষার্থীদের অনেক ধরনের জ্ঞান দ্বারা পড়াশোনা করানোর প্রবণতা এখন কম। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা কোনো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা না থাকলে এমনটিই হয়। চাকরিজীবন শেষ হয়ে যায় তবু অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পান না। এর দরুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কাছেও অজানা থাকছে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া আঁধার ঠেলা যায় না। আর এই আঁধার যারা দূর করবেন, তাদের চেষ্টায় ও আন্তরিকতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে- এই আশা রাখি।

আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম

লেখক :  শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads