• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ভাষার দক্ষতা নিয়ে কিছু কথা

প্রতিদিনকার যোগাযোগের ৩৫ শতাংশ করে থাকি স্পিকিংয়ের মাধ্যমে

আর্ট : রাকিব

মতামত

ভাষার দক্ষতা নিয়ে কিছু কথা

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমরা প্রতিদিন মনের ভাব আদান-প্রদানের জন্য এবং প্রতিদিনকার যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি যে দক্ষতাটি এবং মাধ্যমটি ব্যবহার করি, সেটি হচ্ছে শ্রবণ। আমরা ৪০ শতাংশ যোগাযোগ শ্রবণের মাধ্যমে করি। দ্বিতীয় মাধ্যমটি হচ্ছে কথা বলা বা স্পিকিং। প্রতিদিনকার যোগাযোগের ৩৫ শতাংশ করে থাকি স্পিকিংয়ের মাধ্যমে। পড়ার মাধ্যমে ১৬ শতাংশ এবং লেখার মাধ্যমে ৯ শতাংশ যোগাযোগ করে থাকি। অতএব দেখা যায়, ভাব আদান-প্রদান ও যোগাযোগের জন্য শ্রবণের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারপরেই আসে কথা বলা বা স্পিকিং অথচ আমাদের পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, অ্যাসেসমেন্ট সবকিছুর ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ অর্থাৎ শুধু রাইটিং স্কিল নিয়ে ব্যস্ত। এই ৯ শতাংশ ও রিডিং স্কিল ১৬ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশের ওপর নির্ভর করে পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেডিং। একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই নির্ভর করছে ২৫ শতাংশ স্কিলের ওপর। আমরা শিক্ষার্থীদের বলে দিচ্ছি তুমি ইংরেজিতে এ প্লাস পেয়েছ অর্থাৎ ইংরেজিতে তুমি মাস্টার। যেখানে লিসেনিং ৪০ শতাংশ, স্পিকিং ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ আমরা পড়ানো বা মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে টাচই করছি না, সেখানে কীভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করছি? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। শ্রবণ অর্থাৎ লিসেনিং আমরা যে কারণে বেশি করি, তা হচ্ছে— আমরা সবসময় কথা বলার সুযোগ পাই না; সবসময় কথা বলি না বা লেখারও সুযোগ পাই না; আবার আমরা যখন পড়ি তখন শ্রবণও করি, তাতে সাড়াও দিই। আমরা যখন লিখি তখনো শ্রবণ করি; আমরা চুপচাপ থাকলেও শ্রবণ করি; অর্ধজাগ্রত থাকলেও আমরা শ্রবণ করি।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে স্পিকিং। কোনো পরিচিত কিংবা অপরিচিত যে কারোর সঙ্গেই হোক, কথা বলে আমরা ভাব বিনিময় করি, পরিচিত হই, নিজেকে জানাতে চাই, অন্যের সম্পর্কে জানতে চাই। ভালো কথা বলে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে বা ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে এই স্কিলটি একেবারেই অবহেলিত। শিক্ষক নিজেও প্র্যাকটিস করেন না, শিক্ষার্থীদেরও করান না। এই স্কিলটি প্র্যাকটিস করি না কিংবা করাই না কারণ— পরীক্ষা পদ্ধতিতে লিসেনিং বা স্পিকিং নেই; শিক্ষার্থীরা স্পিকিং বা লিসেনিংয়ের জন্য কোনো ধরনের চাপের মধ্যে থাকে না, আবার কোনো উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশও নেই যে ইংরেজিতে কথা বললে শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হবে। কোনো শিক্ষক বা অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের বলছেন না, ‘তোমাদের এই ক্লাসে অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।’ কিংবা কেউ বলছেন না, ‘তোমাদের অজস্র ধন্যবাদ ইংরেজিতে কথা বলার জন্য’, ইংরেজিতে কথা বলতে শিক্ষকও লজ্জা পান, শিক্ষার্থীরাও লজ্জা পায়; পুরো পদ্ধতি ক্লাসের নীরবতাকে মূল্যায়ন করে সফল ক্লাস হিসেবে। তাই সবাই ইংরেজি ক্লাসেও নীরব থাকে। স্কুল প্রশাসন নীরবতাকে চমৎকার ক্লাস বলে আখ্যায়িত করেন। তাই কিছু আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যদিও ইংরেজিতে কথা বলা এবং শিক্ষার্থীদের বলানোর চেষ্ট করেন, কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের সমালোচনার কারণে তারা আবার নীরবতা পালন করেন এবং বাংলাতেই চলে আসেন। অনেকেই মনে করেন, নীরব ক্লাসই সার্থক ক্লাস, যে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কথা বলে না, চুপচাপ থাকে, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না- সেটিই হচ্ছে সার্থক ক্লাস। আরেকটি কারণ হচ্ছে ইংরেজিতে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য একজন শিক্ষকের যে লেভেলে স্পিকিং দক্ষতা থাকার কথা, অনেক শিক্ষকেরই তা নেই। কারণ তিনিও তো এই পরিবেশ বা এ অবস্থার মধ্যেই ইংরেজি শিখেছেন। তবে শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিস করালে নিজেরও অনেক উন্নতি হবে এ বিষয়টি যারা বোঝেন, তারা এতসব বাধা সত্ত্বেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্র্যাকটিস করান। তাতে শিক্ষার্থীদেরও উপকার হয়, শিক্ষকের নিজেদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।

এসব কারণে ৪০ শতাংশ লিসেনিং, ৩৫ শতাংশ স্পিকিং হওয়া সত্ত্বেও ১৬ শতাংশ রিডিং এবং ৯ শতাংশ রাইটিং অর্থাৎ ২৫ শতাংশ নিয়েই পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সবাই ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। আমাদের সব কর্মকাণ্ড, পরীক্ষা, পড়াশোনা, মান যাচাই, ভাষা জানার মানদণ্ড এবং ফলাফল সবকিছুই এই ২৫ শতাংশকে ঘিরে। ফলে যেসব গ্র্যাজুয়েট আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন, তারা স্পিকিংয়ে দুর্বল থাকেন।

রাষ্ট্র কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের আগে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে এ অবস্থার পরিবর্তন কি শুরু করতে পারি না? অর্থাৎ সর্বোচ্চ ব্যবহূত স্কিল লিসেনিং উন্নত করার জন্য আমরা কিছু একটা কি করতে পারি না?

শিক্ষার্থীদের লিসেনিং উন্নত করার জন্য সবসময়ই আমরা রেডিও টেলিভিশনে সংবাদ দেখার, ইংরেজি মুভি দেখার, বিবিসি, সিএনএন দেখা ও শোনার উপদেশ দিয়ে থাকি। শহর এলাকায় এবং কিছু কিছু গ্রাম এলাকায়ও ছাত্রছাত্রীরা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে টিভি দেখা উপভোগ করে থাকে, তাদের লিসেনিং এবং স্পিকিং কিছুটা উন্নতও। তাদের রিসিপটিভ ক্যাপাসিটিও উন্নত। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে, পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে, ফলাফলের সঙ্গে এগুলো মেলাতে চায়। পরীক্ষা পদ্ধতিতে এগুলো নেই, দেখানোর কোনো ব্যবস্থাও নেই। তাহলে তারা কেন এটি প্র্যাকটিস করবে? এখানেই শিক্ষক হিসেবে আপনার দায়িত্ব। আপনি একদিকে শিক্ষার্থীদের লিসেনিং এবং স্পিকিং বাড়াবেন, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সিলেবাসও প্র্যাকটিস করাবেন। পাঠ্যবই থেকে ভালো ভালো প্যাসেজগুলো আপনি সুন্দর করে ভালো উচ্চারণসহ পড়ে প্রস্তুতি নেবেন। ক্লাসে সেগুলো শিক্ষার্থীদের শোনাবেন। কয়েকটি ফোকাস প্রশ্ন বোর্ডে লিখবেন, যাতে শ্রবণ করার সময় তারা ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে, আরো বেশি বোঝার চেষ্টা করে। এতে ক্লাস আকর্ষণীয় হবে, একঘেয়েমি কাটবে, উন্নত হবে আপনার ডেলিভারি ক্ষমতা, শিক্ষার্থীদের শ্রবণশক্তি উন্নত হবে, ক্লাস অ্যাকটিভ হবে আর তার সঙ্গে শেষ হবে বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সিলেবাসও।

সিলেবাসের পড়াই শুধু লিখতে না দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিন, তাদের উত্তর দিতে উদ্বুদ্ধ করুন, না পারলে ইংরেজিতে বলে দিন। আপনার বলার দক্ষতা বাড়বে, ছাত্রছাত্রীরাও মজা পাবে, তাদের মুখস্থ করার প্রবণতা কমবে। কারণ তারা ক্লাসে বার বার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার ফলে পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তে চলে আসবে। রিডিং স্কিল উন্নত করার জন্য পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে আকর্ষণীয় আর্টিকেল বাছাই করে নিজে পড়ুন, ক্লাসে সেখান থেকে গ্রামারের বিভিন্ন আইটেম শেখান, দেখবেন তাদের আগ্রহ ক্লাসের প্রতি আরো বেড়ে যাবে। লেখার ক্ষেত্রেও ক্রিয়েটিভ পদ্ধতি ব্যবহার করুন। তাদের সম্মিলিত ধারণা একত্র করুন, সেই ধারণাগুলোকে ভাষা দেওয়ার জন্য তাদের উৎসাহিত করুন, নিজে সহায়তা করুন।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads