• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
কোথায় যেন আটকে আছে সব

বেশুমার কাজ যেন আটকে আছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

কোথায় যেন আটকে আছে সব

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কথায় কথায় সারাক্ষণ এখন শুনছি, ‘নির্বাচনের পর হবে...’। ফাইল সই, বদলি, কোনো প্রোগ্রাম, চাকরি, বিশেষ কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কাজ সব ক্ষেত্রেই ‘এখন থাক’— এ রকম শোনা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনটা যাক। মন্ত্রণালয়ে নাকি তেমন কাজ হচ্ছে না! অনেক চেয়ার-টেবিল বেশ স্থবির। আমলারা তেমন কাজ করছেন না। ভেতরে ভেতরে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ সেরে ফেলায় এখন অনেকেই ব্যস্ত। কখন কী হয়, বলা যায় না। বড় বড় স্থাপনা, যেসব নিশ্চিত, আগে-পরে করলে বিশেষ কোনো ফল নেই— তা হয়তো নিজ গতিতে চলছে। তবুও কন্ট্রাক্টর বলেন, ভাইরে ইলেকশনটা যাক। স্থানীয় সরকার, চেয়ারম্যান-মেম্বার, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, চাকরি-বাকরির মৌলিক সিদ্ধান্তে— এক ধরনের ‘না’ মনোভাব। বেশুমার কাজ যেন আটকে আছে। একধরনের মনস্তত্ত্বও তৈরি হয়েছে। মনের জটিল রসায়নে কী হয় কী হয় রকমের ব্যাপার। এটা বেশ প্রভাব ফেলছে মনে হয় জনসমাজে। জনপ্রতিনিধিরাও যেমন তেমন কোনো কাজ করছেন না। করলেও একটু ঢিলে, গা-ছাড়া স্বভাব যেন। বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজে প্রভাব তেমন নেই, কিন্তু আবার ভেতরে ভেতরে এক-আধটু নেই তাও বলা যাবে না। কিছুদিন আগে ডাকসু নিয়ে চেঁচামেচি হলো, সেটাও আবার জট পাকিয়ে গেছে। সবকিছুর লক্ষ্য যেন ‘ইলেকশন’। এমনকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা যেখানে নির্বাচন হয়ে গেল (সাম্প্রতিক সময়ে) সেখানেও একটা ‘ইলেকশনের পর’ মনোভাব গড়তে দেখা যাচ্ছে। এই মনোভাব আর জন-মনস্তত্ত্ব নিয়ে কী বলা যেতে পারে? বলাটা কতটা বাস্তবিক, সেটাও প্রশ্ন। প্রায়ই এ কলামে সমাজ-রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, কথাগুলো একরকম হয়ে যায়, বৈচিত্র্য তেমন পথ পায় না। এরও কারণ আছে। সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে বলার একটা প্রচেষ্টা থাকে, সেটা এখনকার সময়ে অনেকটাই গতানুগতিক, তাই ইচ্ছে থাকলেও বলা যায় না অনেক কিছু। যা হোক, এটা ২০১৮ সাল। এক্ষুণি ইউকে থেকে প্রকাশিত ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় দেখছি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন : ২০২৪ এ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ : রাশিয়ার নিউক্লিয়ার মিসাইল সাবমেরিন প্রস্তুত। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন-চায়না, জাপান-রাশিয়া একটা কোনো তাৎক্ষণিক সমঝোতা বা হুমকির অভিমুখ নিয়ে বুঝি ব্যস্ত। পাশাপাশি যুদ্ধ করতে করতে ‘ঠোসা’ হয়ে যাওয়া সিরিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে মাঝে মাঝে গর্জানো একটু পাতিশাবক তুরস্ক, ইরান, ভারতের মতো দেশ মার্কিন বা রাশিয়া বলয়ে মাঝেমধ্যে সিটিং দিয়ে তৎপর হতেও দেখা যাচ্ছে। ওদিকে দুই কোরিয়া, তাইওয়ান আগের মতো নেই। এই যে, পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি, ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি কিংবা পারস্পরিক প্রভাব বিস্তারের নীতি— সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর বিশ্বের জন্য কী করছে তারা! যোগাযোগের পৃথিবীতে, নতুন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায়, আমরা কী আরো বেশি কাপুরুষ, ভীরু, নতমনস্ক হয়ে পড়ছি না! কেন এই বিশ্বের এ পরিণতি?

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রের গ্লানির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের কথা বলা আছে এভাবে : ‘যে যাবে না সে থাকুক, চলো, আমরা এগিয়ে যাই।... প্রথমে পোড়াই চলো অন্তর্গত ভীরুতার পাপ,/ বাড়তি মেদের মতো বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা।’ এমন প্রত্যয়ের এই আসল কাজটা বুঝি আমাদের সমাজে হচ্ছে না। কেন যেন আমাদের স্নায়ুগুলো পরাধীন, চেতনার জটে সবকিছু আটকে আছে। ভীরুতার পাপে দ্বিধা আর জড়তা বন্দি করে রেখেছে আমাদের, ফলে একটা ক্ষমতা, ন্যস্ত-সামন্ত (feudal) মনোভাব, ইগো আর আত্মচিন্তার সমর্থনে আমরা একটা প্রাকারে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি; হয়তো তা বুঝতে পারছি না, কারণ ওই প্রথাগত শক্তির রক্তধারাতে, আমাদের প্রগতির চাকা আগে থেকেই আটকে আছে (বাইরের ভানটা ছাড়া) এবং বিপরীতে রক্ষণশীলতাকেই বহন করে চলছি আমরা। বাইরের তর্জন-গর্জন আছে, সেখানে যুক্তির মৌখিক স্বীকারোক্তিও আছে, কিন্তু সারাক্ষণ অযুক্তিকেই আমরা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে চলছি; সে অযুক্তির ভেতরে অসাম্য, ক্ষমতা, ইগো, ভীরুতা প্রভৃতি বিষয় কার্যত অসমর্থিত নয়; সমর্থিত। তার একটা দৃশ্যকল্প বা সিনড্রোম ওই নির্বাচন-পূর্ব চলতি আশঙ্কা আর দ্বিধার মধ্যে দেখা যায়। নির্বাচন একটি ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সেটি হওয়া এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া স্বাভাবিক; তাতে জনসমাজে বা ব্যক্তিমনে স্থবিরতা আসবে কেন, আসে কেন, তবে তো ওই ক্ষমতা-কেন্দ্র, ক্ষমতা পাওয়া না-পাওয়া, যেখানে যুক্তি-আদর্শ, মুক্তি-প্রগতি বলে কিছু নেই! তবে সমাজ কি এখন এ রকমই? বিশ্বজুড়েই কি তাই? পুতিন-ট্রাম্পরা যে ঢোলশোহরত সাজাচ্ছেন বা হুমকির আগুনে বাতাস দিচ্ছেন তা কি ক্ষমতা বা সামন্ত মানসিকতারই বহির্প্রকাশ! এই প্রবণতা থেকে এটা অনেকটাই ধরে নেওয়া যায় যে, মানবসমাজে এখনো মানবিকতা অবমুক্ত নয়। এই অবমুক্তি বরাবরের মতো প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেছে। ফলে আমাদের সার্বিক মুক্তি ঘটছে না। ক্ষমতার প্রহরা, দ্বিধার জড়তা, ভয়ের ভাবনা সমূলে থেকে যাওয়ার ফলে এবং নিরন্তর তা চর্চার ফলে, আমরা নির্বাচন-উত্তর ক্ষমতা পাওয়ার বাসনা নিয়ে বুঝি চিন্তাশীল (?)। অপেক্ষার অলস প্রহর গুণে গুণে আবার যখন কাঙ্ক্ষিত সময় ফিরে আসবে তখন পুরনো মচ্ছবে আবার মেতে উঠতে চাই। এই আসা-যাওয়া, পাওয়া-হওয়া আর কতকাল চলবে! আর এতে মানবসমাজেরই বা কী মিলবে!

২.

চলতি সংসদে রেকর্ডসংখ্যক বিল পাস হয়েছে। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিও আছে। এগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিস্তর পর্যালোচনা জরুরি ছিল। ভোট যেহেতু আগুয়ান সেজন্য সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় অনেক দ্রুত এসব জনগুরুত্বসম্পন্ন বিল পাস হয়ে গেছে। এ নিয়ে সচেতন সমাজের অনেকেরই দ্বিমত আছে। কোটা নিয়ে মীমাংসা এখনো হয়নি। হয়তো সেটাও প্রক্রিয়াধীন। ওদিকে পদ্মা সেতুর কাজ আরো এক বছর বেড়েছে। ঢাকা শহর জটমুক্ত করার নানা পদক্ষেপ শোনা গেলেও এখনো কার্যকর কিছু হয়নি (আপাতত জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য হলেও তা হচ্ছে না)। যানজট, জলজট তীব্র। মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্ম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার ধারাক্রম থেকে এখনো ঢাকার মানুষের মুক্তির পথ সরকার তৈরি করতে পারেনি। পরিকল্পনা আছে অনেক, কিন্তু দৃশ্যমান নয়। বর্তমান সরকারের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগও গোছালো বলা যায় না। গত দশ বছরে প্রচুর কাজ হলেও এখনো সেবা তথা মানবসম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই। লেখাপড়ার বিকেন্দ্রীকরণ হলেও তাতে বেশুমার দুর্নীতি ঢুকে গেছে। মান-উন্নয়ন হয়নি। এই লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি নিয়ে সংশয় আছে। প্রচুর বেকার সৃষ্টি হয়েছে, এরা কর্মক্ষম নয়, ফলে কাজ পাচ্ছে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষার মতো উচ্চশিক্ষাতেও ফলপ্রসূ কিছু মিলছে না। বাণিজ্যিকীকরণ কোনো স্তরেই কমেনি, নিয়ন্ত্রণেও নেই। ফাঁকি রয়ে গেছে বেশ। ভালো ডাক্তার কম বেরুচ্ছে। নার্সিং, উপদেশক ও স্বস্তিদায়ক চিকিৎসা তেমন মেলে না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। টাকা থাকলে চিকিৎসা, নচেৎ নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি এই একুশ শতকেও এদেশে অনিশ্চিত। অনেক মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান। কিন্তু আমাদের এ খাতে বরাদ্দ কম নয়! কিন্তু ফল হচ্ছে না। কারণ, জবাবদিহিতার সঙ্কট চরমে। ট্রেড ইউনিয়নের নামে সর্বত্র লুটপাট। এগুলো অনেক দিনের অব্যবস্থা। কিন্তু কোনো সাঁড়াশি পদক্ষেপ কেউ নেয়নি। গরিব, দরিদ্র মানুষ এখনো চিকিৎসা পায় না। প্রাইভেটাইজেশনে ডাক্তাররা ব্যবসায় তীব্রভাবে মত্ত। ওসব মনিটরিংয়ের কেউ নেই। ‘পরিচয়’ আর ‘সম্পর্ক’ ছাড়া এদেশে কিছু হয় না। শ্রেণি মর্যাদাটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কালে কালে। ফলে, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’— এ কথা একদম খাটে না। বাস্তব অবস্থা সত্যিই বেশ নাজুক। উন্নয়নের ধারাটা কোথায় যেন মুখথুবড়ে আছে। সে পলাতকও। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের যে পরিবেশ— সেখানে যে অর্থ লেনদেন চলে, তার সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনা রাত-দিন পার্থক্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান শুধু মর্যাদার নেমপ্লেট মাত্র। ওটি না থাকলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কেউ দাম পায় না। এটা কমপ্লেইন নয়, কিন্তু খেদ। অনেক বড় বড় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এসেছে, কিন্তু তার ব্যবহার নেই। অথচ ক্লিনিকে বেশ বারোরকম ব্যবসা। শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা চরম হুমকির মুখে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণের যে প্রজেক্ট চালু হয়েছে, তা পুরনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ পরিপন্থী। সাংঘর্ষিকও। জবাবদিহিতা না থাকায় বিচিত্র সমস্যায় জর্জরিত উচ্চশিক্ষার প্রক্রিয়া। কথাগুলো কান টানলে মাথা আসার মতো। আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্কট থেকেই সর্বস্তরে এ পরিণতি দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আধুনিক সমাজ গঠনের কাজটি আমাদের জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং বাংলাদেশ সম্মুখে এগোনোর জন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে আরো কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতি ও জবাবদিহিতা— এ দুটো সর্বোচ্চ পরিমাণে নিশ্চিত করলে আইন-শাসন-বিচার সুপথে চলবে। তাতেই অনেক কিছু করা সম্ভবপর হবে এবং এই সম্ভবপরতার ভেতরেই মৌলিক রূপান্তরগুলো ঘটতে সক্ষম। সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ব্যক্তিক পর্যায়েও তখন পরিবর্তন আসতে সক্ষম হবে। তৈরি হবে নতুন প্রান্ত। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যেভাবেই হোক এখন কোণঠাসা— যেটা কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় মনে হতো। এই অকল্পনীয় কাজ আবার করার জন্য দুর্নীতিকে না বলতে হবে। এটা এখন জরুরি। এ থেকে বেরুতে পারলেই যে দ্বিধা ও জড়তার কথা বলেছি— সেটার সমাধানের পথ বেরুবে; এই চলমান সমাজের ভেতর থেকেই বেরুবে, মানুষই সে পরিবর্তনটি আনতে সক্ষম থাকবে। আমরা দেখেছি একসময় পরীক্ষায় নকল হতো। সেটি এখন বন্ধ করা গেছে। এভাবে দুর্নীতিকেও তীব্রভাবে দমন করতে হবে। তবে জবাবদিহিতা তৈরি হবে।

৩.

আমরা ২০২৪ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, মূল্যবোধভিত্তিক মানবিক সমাজ চাই। মানবপৃথিবীর এ আন্দোলনে বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষ অবদান রাখতে পারে। যদি আমরা নিজেরা প্রগতির পথে চলি, তবে মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ গড়তে পারি। এদেশের নতুন প্রজন্ম যেটা চায়, আমরা সে পরিবেশটা কতটা করে দিতে পারব— এখন সেটাই প্রশ্ন। সেজন্য ‘নির্বাচনের পর’— এ কথাটা দ্বিধা ও চৈতন্যের জড়তার কথা। আমরা কাজগুলো রুটিন ওয়ার্কের মতো সর্বস্তরে এখনই কেন করতে পারি না! সরকার তো নিমিত্ত মাত্র। সেটা করতে পারলেই সর্বস্তরে শান্তি আসবে আর ব্যক্তি-পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে তখন বাংলাদেশ সবার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads