• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

কৃষির সমৃদ্ধি ব্যতীত প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধি অর্জন করাও সম্ভব হবে না

আর্ট : রাকিব

মতামত

কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কৃষির সমৃদ্ধ ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব নয়। অবশ্য ইতোমধ্যেই কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সমৃদ্ধি এসেছে। এখন ধান, গম উৎপাদনের পাশাপাশি সবজির উৎপাদনও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবজি উৎপাদনে গোটা বিশ্বে এখন তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। যদিও সবজির সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগারের বড়ই অভাব। অনেক সময়ই সবজির বাড়তি উৎপাদন হলেও সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতি হয় শত শত কোটি টাকা। অথচ কৃষি অর্থনীতির দেশে কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ফসল উৎপাদন হলেও সরকারের সময়োপযোগী কর্ম-পরিকল্পনার অভাবে সবজি চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ায় চাষের ধারাবাহিকতাও ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এখন সারা বছরই টমেটো, বেগুন, করলা জাতীয় কৃষিপণ্যের চাষাবাদ হয়। যখন মৌসুম আসে, তখন টমেটো চাষিরা ব্যাপক হারে টমেটো চাষ করে অনেক সময়ই ন্যায্যমূল্য পান না। তখন চাষিরা পরের বছর টমেটো চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্য সবজি চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। ফলে স্বাভাবিকভাবে টমেটোর উৎপাদন কমে আসে। বাড়তি মূল্যে ভোক্তাদের টমেটো কিনে খেতে হয়। অর্থাৎ ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। যদি সংরক্ষণ উপযোগী পর্যাপ্ত হিমাগার থাকত, তাহলে সবজি চাষিরা ভরা মৌসুমে টমেটো হিমাগারে রাখত, যা স্থানীয় ভোক্তার চাহিদা পূরণ করার পর বাড়তি টমেটো বিদেশে রফতানি করাও সম্ভব হতো। কিন্তু আমাদের দেশে চাষিবান্ধব পরিকল্পনার অভাব এবং সবজি চাষে অপরিকল্পিতভাবে বালাইনাশক ও রাসায়িনক সার ব্যবহার করায় অনেক সময় সবজিতে ব্যাকটেরিয়া আক্রান্তের কারণে ওই সবজি বিদেশে রফতানি করতেও নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই সবজি রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি জাতীয় এক দৈনিকে ‘বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিপণ্যের রফতানি’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনাবৃষ্টি এবং নদ-নদীর পানি শুকিয়ে ছোট-বড় অধিকাংশ নদী এখন সঙ্কোচিত হয়ে আসছে। ফলে বিশাল বিশাল চরের সৃষ্টি হচ্ছে। আর চরাঞ্চলের দো-আঁশ মাটিতে এখন ব্যাপকভাবে আলু, ভুট্টা ও শাক-সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলসহ গোটা দেশেই এখন আলুর ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। বছরে আলু উৎপাদন হয় প্রায় ১ কোটি টনেরও অধিক। দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করার মতো এখন সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও রাশিয়ায় আলু রফতানি হয়েছে। কিন্তু আলুতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়ায় বেশ কয়েক বছর যাবৎ রাশিয়ায় আলু রফতানি বন্ধ আছে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় বাংলাদেশের পানের প্রচুর কদর ছিল, সেখানেও বিপত্তি! পানে ব্যাকটেরিয়া ধরা পড়ায় দীর্ঘদিন ধরে পান রফতানি বন্ধ আছে। রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, মানসম্মত বীজের অভাবসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ট প্রটেকশন কনভেনশন (আইপিপিসি) সনদ অনুসমর্থনকারী দেশ। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশকে সংস্থা দুটির নিয়ম-কানুন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। শুধু বরই বাদে সব ধরনের শাক-সবজি ও ফলমূল রফতানির জন্য উন্মুক্ত আছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছিল ৩৫২ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমান অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছে ৪০৬ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে শাক-সবজির একই সময়ের রফতানি ৫০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৪৯ দশমিক ০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। এর মধ্যে আলু রফতানির হার খুবই নিম্নমুখী। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১৮ হাজার টন আলু রফতানি হয়েছিল, যা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১৫৭ টনে। অথচ বিপুল পরিমাণ আলু এখন দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। আলু চাষিদের আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে আলু উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেশি হতো। এ জন্য সরকারকে আলু রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে শুধু রাশিয়ায় নয়, অন্যান্য দেশেও তৎপরতা বৃদ্ধি করা উচিত।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় যেহেতু শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য রফতানির সুযোগ রয়েছে, সেহেতু আমাদের উচিত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য তৎপরতা বৃদ্ধি করে পানে যে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নেই, তা নিশ্চিত করা। পান রফতানিকারকদের দাবি, পান চাষিরা কিছু কিছু স্থান নির্ধারণ করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে স্যালমোনেলামুক্ত পান উৎপাদন করছে, যা তিনটি ল্যাবরেটরিতে পান পরীক্ষা করার পর স্যালমোনেলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এর পরও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, যেহেতু বাংলাদেশে মানসম্মত অ্যাক্রেডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করার মতো মানসম্মত ল্যাবরেটরি নেই, সেহেতু ব্যাকটেরিয়া নেই মর্মে রফতানিকারকরা দাবি করলেও তারা তা মানতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই মানসম্মত ল্যাবরেটরি স্থাপন করে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আমদানিকারক দেশের প্রতিনিধিদের পরীক্ষা করে দেখাতে হবে যে, পানে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া নেই। তানা হলে ইইউর দেশে পান রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা আদৌ সম্ভব হবে না।

এমতাবস্থায় আমাদের দেশে কৃষিপণ্য রফতানির জন্য অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা খুবই জরুরি। কৃষি প্রধান আমাদের দেশ। কৃষির সমৃদ্ধি ব্যতীত প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধি অর্জন করাও সম্ভব হবে না। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্য পরীক্ষার মতো মানসম্মত ল্যাবরেটরি স্থাপনে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ নেই। এটাই এদেশের চাষিদের দুর্ভাগ্য! ফলে চাষিরা নিরন্তর শ্রম দিয়ে চেষ্টা করলেও সহসাই সুফল মেলে না। আর এ কারণে কৃষিতে সমৃদ্ধি এলেও কৃষিপণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads