• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
অনলাইন ব্যাবহারে পিছিয়ে সরকারি ব্যাংক

বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকেও সেবা দিতে হবে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

অনলাইন ব্যাবহারে পিছিয়ে সরকারি ব্যাংক

  • প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শফিকুল ইসলাম খোকন

বাংলাদেশ এখন তথ্য-প্রযুক্তিতে এগিয়ে, সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই। ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে- এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরে প্রযুক্তির ছোঁয়া যে নেই সেটিও বাস্তবতা। এখন শহরের মতো গ্রামীণ জনগণও ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং তাদের এই সুবিধা দিচ্ছে। ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। এতে সাধারণ ব্যাংকের মতোই প্রায় সব সুবিধা পাওয়া যায়। এজন্য গ্রাহককে বাড়তি কোনো চার্জও পরিশোধ করতে হয় না। আবার ব্যাংকের ডেবিট কার্ড ব্যবহারেরও সুযোগ পাওয়া যায়। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে ব্যাংকিংয়ের এই ধারা। এখন গ্রামীণ এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সংখ্যা শহরের তুলনায় ছয় গুণ বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন প্রযুক্তির ছোঁয়া অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয়, তখন সরকারি দফতরগুলো কেন পিছিয়ে? কেনই বা অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে এতটা পিছিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো?

সম্প্রতি একটি গবেষণা বলছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের দিক থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার কথা। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কথা বলা যায়। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন ব্যাংক। এ ব্যাংকের অগণিত গ্রাহক রয়েছে গ্রামগঞ্জে এবং শহরে। কিন্তু এ ব্যাংকটিতে অনলাইনভিত্তিক সেবা না থাকায় বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। তথ্য-প্রযুত্তিতে দক্ষ কর্মীর পেছনে ১ টাকা ব্যয় করলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ২৫ টাকা। এ ছাড়া অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে ‘কস্ট অব ফান্ড’ ৬ টাকা থেকে কমে ২ টাকা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন ব্যাংকিংয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা হতাশাজনক। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের ব্যাপক উন্নতি হলেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে সরকারি ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে সরকারি ব্যাংককে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এটি হতাশাজনক।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ‘ব্যাংকের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধিতে আইসিটির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, ‘প্রথাগত ব্যাংকিং মাধ্যমে এখন বছরে গড়ে ১৭০ কোটি বার লেনদেন হচ্ছে। আর আইসিটির কারণে অনলাইনে ২০০ কোটি বারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যাংক খাতের একজন কর্মী এখন বছরে গড়ে ১০ হাজার লেনদেন সম্পন্ন করছেন। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের একজন কর্মীর গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজারের কম। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকে ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।’ গবেষণার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে আইসিটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ব্যাংকের একজন কর্মী গড়ে ৪১ কোটি টাকা লেনদেন করতেন। সেটি ২০১৫ সালে প্রায় চার গুণ বেড়ে ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেন সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে একজন কর্মীর আর্থিক লেনদেনের দক্ষতাও এ সময়ে প্রায় চার গুণ বেশি বেড়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাও এ সময় বেড়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সরকারি ব্যাংকের লোকসানের কারণে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত লোকসানের মধ্যে ছিল। সেই অবস্থা থেকে ২০০০ সালে ব্যাংকিং খাতের গড় মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকা। এ মুনাফা ২০১৫ সালে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, ১৭টি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এর মধ্যে গ্রামের মানুষই ১৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৭৭ জন। বাকিরা শহরের। এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে মোট স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫১ কোটি টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এজেন্টের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৮টি এবং যাদের আউটলেট রয়েছে ৫ হাজার ৩৫১টি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন মাসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নতুন গ্রাহক হয়েছেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৪৩০ জন। ২০১৮ সালের মার্চ শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৭ জনে। তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারে অর্থ লেনদেনে জনপ্রিয় মাধ্যম স্মার্ট কার্ড, অনলাইন ও এটিএম ব্যাংকিং সেবা। তবে কয়েকটি বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকে জালিয়াতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়লে গ্রাহকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এমনকি সম্প্রতি এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় পাওয়া ছবি দেখে বিদেশি এক নাগরিককে পুলিশ গ্রেফতার করলে বিষয়টি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়। এখন অন্তত সবাই বিষয়টির ভয়াবহতা সহজেই আঁচ করতে পেরেছেন। চেকের বিকল্প হিসেবে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ইলেকট্রনিক পেমেন্ট চ্যানেল বাংলাদেশে যখন সবে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যবহার শুরুর পর্যায়ে, সেখানেই এমনি জালিয়াতি সবাইকে প্রচণ্ড রকমের হতাশ করেছে। সব মিলিয়ে অনলাইন ব্যাংকিং সেবা অনেক এগিয়ে। তারপরও এসব অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেখভালের যেমন দায়িত্ব, তেমনি সরকারেরও নজরদারি রাখতে হবে।

যাই হোক, তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকেও সেবা দিতে হবে। বর্তমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণই একমাত্র সমাধান। ঢেলে সাজাতে হবে সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টর। আমাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টজনদের আরো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন করে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইসিটি বিষয় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া দরকার।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। বর্তমানে আইসিটির কারণে ব্যাংকিং খাতে নতুন অনেক সেবা এসেছে, কর্মদক্ষতা বেড়েছে। সে অনুযায়ী সরকারি ব্যাংক অনেকটা পিছিয়ে। এ অবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় পরিবর্তন আনাও জরুরি। তা না হলে, অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে সরকার অনেক পিছিয়ে থাকবে। ফলে পিছিয়ে পড়বে গোটা দেশ। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বায়নে তা মোটেও কাম্য নয়।

লেখক : স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads