• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
সব সিমে একই কলরেট কাম্য নয়

কলরেট কমানোয় অতীতের কোনো সরকারই ভূমিকা রাখেনি

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

সব সিমে একই কলরেট কাম্য নয়

  • প্রকাশিত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মোহাম্মদ আবু নোমান

যে সিদ্ধান্তটি ১৫ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত, তা বাস্তবায়নের পূর্বে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত ছিল। বিটিআরসির হিসাব মতে, জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত অপারেটরভেদে দেশে ১৫ কোটি ২৫ লাখ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এই মোবাইল ব্যবহারকারীরা নিজেদের প্রয়োজনে মোবাইলে কথা বলেন টাকা খরচ করে। হঠাৎ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন কোন যুক্তিতে মোবাইল ফোনে কথা বলার মূল্য বৃদ্ধি করল? গত ১৪ আগস্ট মধ্যরাত থেকে দেশের যেকোনো মোবাইল ফোনে কথা বলার রেট সমান করা হয়েছে। ন্যূনতম পরিমাণ প্রতি মিনিটে ৪৫ পয়সা, আর সর্বোচ্চ ২ টাকা। এই সর্বনিম্ন রেট বেঁধে দেওয়ার পরিমাণটাও যৌক্তিক কি? সর্বোচ্চ দামটা বেঁধে দিয়ে সর্বনিম্ন দামের বিষয়টি অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দিলে একটা প্রতিযোগিতা থাকত। গ্রাহক টানতে কোনো কোনো কোম্পানি কম মূল্যের অফার দিত। লাভবান হতো ভোক্তারা।

১৯৮৯ সালে মোবাইলের যাত্রা শুরুর পর থেকেই কলরেট কমানোয় অতীতের কোনো সরকারই ভূমিকা রাখেনি। অপারেটররা পরস্পর বিজনেস প্রতিযোগিতায় কমিয়েছে। প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেড একচেটিয়াভাবে সেট, সংযোগ ও কথা বলার গলাকাটা রেটের মাধ্যমে এর সূচনা করে। বর্তমানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের সীমানা ছাড়িয়ে নিম্নবিত্ত ক্ষেতমজুর, গৃহকর্মী, ফকির, মিসকিনের হাতেও রয়েছে মোবাইল ফোন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সিম সংযোজন ফি ও কলরেট এতদিন উপরোক্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে একটি স্বস্তির অবস্থানে ছিল। আগেও সবাই অননেট-অফনেট উভয়ভাবেই নিজ নিজ প্রয়োজনমতো কথা বলতেন। অননেট, অর্থাৎ সেই কোম্পানিরই ফোনে আলাপ করা যেত বেশ সস্তায়। অন্যদিকে ভিন্ন কোম্পানির কোনো ফোনে, অর্থাৎ অফনেটে কথা বলতে কিছু বেশি খরচ হলেও সহনীয় ছিল।

কলরেট বেড়ে যাওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত, নতুন উদ্যোক্তা ও গরিব মানুষ। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন উচ্চশিক্ষিত প্লাস্টিক পণ্যের উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার পণ্যের পরিচিতি ও বাজারজাতকরণের জন্য আমি রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি। মাসে ২০ হাজার টাকা ইনকাম হলেই আমি খুশি। যোগাযোগ এবং বিল কালেকশনের জন্য দৈনিক শতাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলতে আমার মাসে দুই হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়। অথচ এখন আমার মোবাইলের ব্যয়ই দ্বিগুণ বেড়ে গেল।’ এমনিভাবে ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ব্যবসায় জড়িত এবং পোশাকের মার্কেটিংয়ে কর্মরতরা বলেন, ‘এমনিতেই বিভিন্ন খরচে দিশেহারা, তারপর নিজের খাওয়া-পরা, বাবা-মা, ভাই-বোনদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে এখনো বিবাহের চিন্তা করতে পারিনি। আমাদের এ সার্ভিসের প্রধান মাধ্যম হলো মোবাইল। অথচ সরকার মোবাইলে কথা বলার রেট বাড়িয়ে আমাদের মাথায় ঘা মারল।’

এ ধরনের একক কলরেট ধার্য করার কি খুব প্রয়োজন ছিল? গ্রাহকদেরও এই নিয়ে কোনো দাবি ছিল কি? বরং কয়েকটি কোম্পানি প্রতিযোগিতা করে উত্তরোত্তর ভালো সুবিধা দিয়ে যাচ্ছিল সাশ্রয়ী মূল্যে। এ সুযোগ থেকে আকস্মিকভাবে গ্রাহকদের বঞ্চিত করার সুবিধাটা কী হলো, তা দুর্বোধ্য। গ্রাহক কোন কোম্পানির সিম, কতটি সিম ব্যবহার করবে সেটা তার ব্যাপার। যে কোম্পানি বেশি বেশি সুযোগ দেবে মানুষ তাদের সিম ব্যবহার করবে, কিন্তু সব সিমে একই কলরেট এটা কার চাহিদায়? পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে মূল্য বৃদ্ধির জন্য কোনো কারণ লাগে না। সর্বশেষ অনেক কিছুই জনগণের কাঁধে এসে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না। খুঁজতে গেলে বিশেষ কিছু ব্যক্তির, বিশেষ কোনো স্বার্থ হয়তো পাওয়া যাবে। এভাবে জনগণকে বেচে খাওয়ার অভ্যাস বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও আছে কি? তাহলে কার সুখের জন্য করা হলো? কারা সেই সুফলভোগী? বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি সুবিধাভোগীরা কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের ফোন ফ্রি, কল ফ্রি, বাসা ফ্রি, যাতায়াত ফ্রি। আসলে জনসাধারণকে বোঝার, ভাববার মতো কেউ আছে কি? নাকি, যা মন চায় তা-ই করে ফেললাম?

বিভিন্ন মহল সরকার থেকে নানা সুযোগসুবিধা নেয়। তাদের খুঁটির জোর বড় শক্ত! কিন্তু এর বিনিময়ে কোম্পানিগুলোর যে ছাড় দেওয়ার কথা, তা কি তারা দেয়? গত বাজেটে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবার ওপর ধার্যকৃত চার্জ কি কমেছে এক পয়সাও?

গ্রামীণফোন, রবি এবং বাংলালিংক- তিনটিতে সিংহভাগ বিনিয়োগ বিদেশিদের। তাদের লাভও বিদেশে যাচ্ছে। তাদের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা ভিন দেশের লোক। বেতনও পান অনেক টাকা। অথচ এখানে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে বিদেশি কোম্পানির লাভের সুযোগ করে দেওয়া হলো। জনগণকে পরোয়া না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কেম্পানির মতো রাজত্ব করার সুযোগ দেওয়া হলো। মোবাইল কোম্পানিগুলো কিছু অসম্ভব, অসঙ্গত ও আজগুবি অফার দিয়ে থাকে। যেমন- ১৭ টাকায় ৩ জিবি নেট সময় ৩ ঘণ্টা। অর্থাৎ, কাউকে ১ কেজি মুড়ি খেতে দেওয়া হবে, কিন্তু সময় নিতে পারবে ৩ মিনিট! সাধারণ জনগণ এসব নীরবে সহ্য করে যায়। এসব দেখার যেন কেউ নেই।

নির্বাচনী বছরে সরকার আগামী ভোটের কথা চিন্তা করে ১৫ কোটি ২৫ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কলরেট বৃদ্ধির অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এলেই ভালো হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

লেখক : নিবন্ধকার

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads