• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প

কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প

  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এ এইচ এম ফিরোজ আলী

বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প হচ্ছে পর্যটন শিল্প। সারা বিশ্বে কর্মসংস্থানের দিক থেকে পর্যটন শিল্প বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্প থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছিল ১ হাজার ৭৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের অনেক দেশ প্রতি বছর অন্য যে কোনো বড় শিল্পের চেয়ে পর্যটন শিল্প থেকে আয় করে বেশি। পর্যটন শিল্প এখন বিশ্বের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাবমতে, ২০২০ সাল থেকে বিশ্বে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা হবে পর্যটন খাত থেকে। সারা বিশ্বের ১০০ মিলিয়ন মানুষ জীবন-জীবিকার সুযোগও সৃষ্টি করবে। বর্তমানে পৃথিবীতে ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই ১০০ কোটি পর্যটকের মধ্যে ৫০ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপে, আর ২০ শতাংশ আসছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বাকিরা অন্য মহাদেশে যাতায়াত করছে। পর্যটনে বিশ্বের এমন সম্ভাবনাময় বাজার ধরে রাখতে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, চীন, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। মালয়েশিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পই বছরে অবদান রাখছে প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৫ সালে ২৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নেয় থাইল্যান্ড। নেপালের জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশ উৎস হচ্ছে পর্যটন খাত। বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান সিঙ্গাপুরে ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ান, হংকং, ফিলিপাইন ৫০ শতাংশের বেশি। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই আসে পর্যটন খাত থেকে। ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোর মোট রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে।

সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম। স্বল্প আয়তনের জনবহুল এই দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যুগে যুগে মুগ্ধ হয়েছেন পর্যটকরা। বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বত, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, নদী-সাগর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ মিনার, বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলসহ নানা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। সমতল ভূমির অপরূপ সৌন্দর্যের এ দেশটির নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ফলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।

পর্যটন শিল্পের বহুমাত্রিকতার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনাও আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজস্ব খাতে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব বাংলাদেশের জন্য অনস্বীকার্য। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দেশের অভ্যন্তরে ৯৮ লাখ মানুষ পর্যটন স্পট সরেজমিনে দেখতে যান। ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাবমতে, আমাদের দেশে সরাসরি পর্যটন খাতে কর্মরত আছেন ১৫ লাখ লোক এবং পরোক্ষভাবে আরো ২৩ লাখ লোক জড়িত। সব মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতে। আর এর আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকা।

১৯৮০ সাল থেকে আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন শিল্পের জন্ম হয়। প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যটন দিবস পালন করা হয়। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পার হয়ে দেশের পর্যটন শিল্পের অনেকটাই বিকাশ ঘটেছে। পর্যটন সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমের তথ্যমতে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা গড়ে প্রায় ৯৮ লাখ। ২০১২ সালে মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৩৯ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১ হাজার ৯৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে, যা হবে বৈদেশিক আয়ের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন খাত অন্যতম সমৃদ্ধিশালী শিল্পে পরিণত হবে। ২০২৩ সাল নাগাদ জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ আসবে পর্যটন খাত থেকে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের ২০১৬ সালের বার্ষিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১০ বছর পর পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান হবে বিশ্বের মধ্যে ১৮তম। ২০২৬ সালে পর্যটন খাতে প্রত্যাশিত প্রত্যক্ষ জিডিপি দাঁড়াবে ৭৩৮ দশমিক ১ বিলিয়ন টাকা। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটলে বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে পর্যটনের অপরিসীম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা না থাকা, বিদেশিদের জন্য বিশেষ এলাকা গড়ে না তোলা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, আবাসনের অপ্রতুলতাসহ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ প্রক্রিয়া। দেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবন সমুদ্রসৈকত সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। একই অবস্থা রাঙামাটির সাবলং ঝরনা, বান্দরবানের শৈলপ্রপাত ও বগা লেক। তারপরও নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আগের তুলনায় বর্তমান সময়ে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতি পাল্টে দিচ্ছে।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দিতে টেকনাফের সাবরাংয়ে ‘সাবরাং অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামে পর্যটন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক মানের সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন পর্যটন স্পট। এছাড়া নাফ নদীর বুকে জেগে ওঠা জালিয়ার দ্বীপের ২৭১ একর ভূমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে নাফ ট্যুরিজম পার্ক। ইতোমধ্যে ৪৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ কলাতলী হয়ে সাগরের কূল ঘেঁষে নির্মিত বিশ্বমানের সড়কটি সাবরাং অর্থনৈতিক অঞ্চলে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পর্যটকদের পদভারে মুখর হবে এ অঞ্চল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার পর্যটনে ২৭টি পর্যটন স্থানকে চিহ্নিত করে ৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এগুলো হচ্ছে মাধবকুণ্ড, রাতারগুল, মাধবপুর লেক, বিছানাকান্দি, পানামনগর, ময়নামতি, নীলাচল, মেঘলা অবকাশ কেন্দ্র, বগুড়া মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, কক্সবাজার, সুমংদুর্গাপুর, বিজয়পুর, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদ, টেকের ঘাট, শ্রীমঙ্গল ও বাকের টিলাসহ অন্যান্য স্থান।

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে অগ্রগতি আনতে হলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ডকে টার্গেট করতে হবে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে তাদের সব কৌশল আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসলামিক দেশগুলোকে টার্গেট করে পর্যটক আকৃষ্ট করতে ট্যুরিজম বোর্ড কাজ করছে। পর্যটন করপোরেশনের মতে, এ শিল্পের উন্নয়নে ৩৪ হাজার নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পর্যটন এলাকার হোটেলে স্বল্পমূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ একটি পরিবেশবান্ধব নীতিমালা তৈরি করে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে সম্ভাবনাময় এ শিল্প বাংলাদেশকে বদলে দেবে। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads