• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আমেরিকার আপদ, তুরস্কের বিপদ ও সমমনাদের দাপট

  • সাদিকুর সাত্তার আকন্দ
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, কস্তুরীই হরিণের শত্রু। কথাটি বর্তমান তুরস্কের রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেকটাই যথার্থ। বিগত তের-চৌদ্দ বছরে তুরস্ক তার রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গের উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী। তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক এমনকি নিকট অতীতের বিভিন্ন বক্তব্য আওড়ালে এমনটাই পাওয়া যায়। রাজনীতি বোদ্ধাগণ মনে করেন তুরস্কের উন্নতি ও অগ্রগতিই তুরস্ককে পশ্চিমাদের শত্রুতে পরিণত করেছে। যদিও এ বিষয়টির ওপর যথেষ্ট যুক্তি খণ্ডনের সুযোগ রয়েছে। এর পূর্বে আলোচনাযোগ্য বিষয় হতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র কেন দিন দিন তুরস্কের সঙ্গে বৈরিতার সম্পর্ক আরো ভারী করছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের ভবিষ্যৎ বাক ও স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্টতা আসবে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প জেতার পেছনে যে কয়েকটি কারণ ইতোমধ্যে বিশ্বময় আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে একটি হলো ট্রাম্পের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হয়তোবা চিন্তা করেছে, যদি ডেমোক্র্যাটদের কেউ আবারো প্রেসিডেন্ট হন সেক্ষেত্রে তাদের পররাষ্ট্রনীতি এতটা পরিবর্তিত হবে না। কারণ ট্রাম্পের পূর্বে দুই মেয়াদে আমেরিকাবাসী ডেমোক্র্যাটদের দেখেছে। বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে নাক-গলানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে বারাক ওবামার সময়ই শীতল সম্পর্ক চলছিল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে ট্রাম্পের লাগামহীন কথাবার্তায় ইসরাইল যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, তাতে অনেক আমেরিকান নাগরিকই হয়তোবা ভেবেছেন যে, যেভাবেই হোক আমেরিকাকে এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে আমেরিকা বিশ্ব নেতৃত্ব দেবে, নতুবা আমেরিকা চুপটি মেরে বসে থাকবে। বারাক ওবামার সময়ে চীন-তুরস্ক-রাশিয়া-ইরান সম্পর্ক শক্ত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসুবিধাজনক। ট্রাম্প হয়তোবা এ পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক গেম খেলতে পারবে- এমনটা চিন্তা ভোটারদের মধ্যে আসতেই পারে। যে কারণে ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, ট্রাম্প তার কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছেন এবং আলোচনায় এসেছেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আলোচনার টেবিলে জং কিমের মতো একরোখা মানুষকে নিয়ে আসাটা অবশ্যই কঠিন কাজ। এ বৈঠকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে না পৌঁছালেও অন্তত শত্রু শত্রু ভাবটা একটু হলেও কমবে- এটাই ট্রাম্পের জন্য একটা পোর্টফোলিও। বর্তমানে আমেরিকা বা ট্রাম্পের জন্য আপদ হিসেবে দুটি দেশ বেশ শক্ত বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকগণ। এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তুরস্ক আর অপরটি চীন।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তুরস্কই প্রথম প্রতিবাদ জানায় আর সিরিয়া ইস্যুতে এ পর্যন্ত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানই বেশি বক্তব্য দিয়েছেন। যেটি ট্রাম্প বা আমেরিকাওয়ালাদের কাছে বেশি বিব্রতকর। স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইল মনে করে, এরদোগান কোণঠাসা অবস্থায় থাকলে ইসরাইলের জন্য ভালো।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধটি তুরস্কের জন্য বড় বিপদ। এটা যেকোনো রাজনীতি বোদ্ধাই অকপটে স্বীকার করছেন। তুরস্কের জন্য এমন ধরনের কিছু রাজনৈতিক বিপদ আসন্ন, এটা পূর্বেই অনেকটা অনুমেয় ছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সম্প্রতি গত হওয়া তুরস্কের আগাম নির্বাচনটি যেমন চ্যালেঞ্জের ছিল, তেমনি ছিল নিজের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি অগ্নিপরীক্ষা। মূলত তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক যতটা বৈরী তার চেয়ে বেশি মন্দ সম্পর্ক আমেরিকা বনাম এরদোগানের। বিগত ২৪ জুন ২০১৮ সালের আগাম নির্বাচনটি তুরস্কের জন্য দুটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এক. অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আর দুই. রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যার একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে অন্যটি এমনিতেই হয়ে যাবে। আর না পারলে দুটিতেই ব্যর্থ হতে হবে এরদোগান প্রশাসনকে। তুরস্কের চলমান মুদ্রাযুদ্ধের মিত্র হিসেবে রাশিয়া-ইরান-চীনের অবস্থান তুরস্কবাসীকে খুব আশা জাগানিয়া করে তুলেছে। যদি এই আশা কখনো নিরাশায় রূপ নেয়, তাহলে এরদোগান ও একে পার্টির ভবিষ্যৎ কী হবে তা সময়ই বলবে। তুরস্কের বর্তমান সঙ্কটকালে ইরান-রাশিয়া-চীন-ইইউর  সমমনা আন্দোলন যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে- এর একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়াও থাকবে। যেমন- ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে তুরস্ককে রাশিয়ার প্রতি একটু নরম আচরণ করতে দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে। ঠিক তেমনি মুদ্রাযুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোকে গভীরভাবে পাশে পেতে চাইলে দীর্ঘমেয়াদে অনেক ছাড় দিতে হতে পারে তুরস্ককে। যে কারণে তুরস্ক চাইলেও হয়তোবা মুসলিম বিশ্বের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে নাও পারতে পারে। এ ধরনের অদৃশ্য কিছু বাধা তুরস্ককে মাড়িয়ে যেতে হবে, যা আদর্শিক রাজনীতিতে অতি কঠিন কাজ। সিরিয়া ইস্যুতে কথা বলতে গেলে ইরানের বিষয়টি মাথায় রেখে বলতে হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বলতে গেলে চীনের বিষয়টি মাথায় রেখে কথা বলতে হয়।

কারণ এই সঙ্কটের পক্ষে-বিপক্ষে বলার ওপর কূটনৈতিক সম্পর্কের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। সুতরাং রাশিয়া-চীন-ইরান-ইইউসহ মিত্রদের মন রক্ষা করাই তুরস্কের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। যে কারণে তুরস্কের ওপর মিত্র দেশগুলোর নরম দাপট স্বাভাবিকভাবেই একটু বাড়বে।

নিবন্ধের শুরুতে যে প্রবাদ বাক্যটি দিয়ে শুরু করেছি সেটার বাস্তবিক ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। প্রাণী বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় আওড়ালে এক ধরনের হরিণের কথা অহরহই চলে আসে। যার ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। তাদের নাভির কাছে বিশেষ এক ধরনের গিট রয়েছে নাম ‘কস্তুরী’। এটি অতীব সুগন্ধিযুক্ত একটি অংশ। সাধারণত সব ধরনের হরিণের মধ্যেই কম-বেশি সুগন্ধি যুক্ত কস্তুরীর হরমোন রয়েছে। তবে মাস্ক ডিয়ারে এর পরিমাণ বেশি থাকে। হরিণের বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয়, তখন তার দেহের কস্তুরীর ঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। যে কারণে মিষ্টি ঘ্রাণে আকৃষ্ট হয়ে শিকারি প্রাণীগুলো ওই হরিণের অবস্থান খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে পেয়েও যায়। আর এতে হরিণটিকে শিকার করতে শিকারি প্রাণীর অনেক সুবিধা হয়। মূলত কস্তুরীই হরিণের শত্রুকে হরিণটির অবস্থান স্পষ্ট করতে সাহায্য করে। এজন্যই মানুষ বলে, ‘কস্তুরীই হরিণের শত্রু।’ আধুনিক তুরস্কের যত উন্নয়ন সব বিগত ১৩-১৪ বছরে হয়েছে। এটা যেকোনো রাজনীতি বিশ্লেষক ও সমালোচকই স্বীকার করবেন। তুরস্ক বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনীতি, সামাজিক, কূটনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বহুপথ এগিয়েছে। তা ছাড়া ভৌগোলিক দিক দিয়ে তুরস্ক এমন একটি জায়গায় অবস্থিত, যেখান থেকে বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়া ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে সহজ। আর এগুলো হলো তুরস্কের সৌন্দর্য, যা তুরস্ককে একটি নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে গেছে। এই সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার কারণেই তুরস্কের সামনে এত চ্যালেঞ্জ ও বিপদ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads