• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়াতে হবে

সেলাই হচ্ছে পাটের বস্তা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়াতে হবে

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

একসময় পাট ছিল কৃষকের অর্থকরী ফসল। ছিল দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত। পাটকে বলা হতো বাংলার সোনালি আঁশ। কেবল স্বর্ণের মতো রঙের কারণে নয়; বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হওয়ায় পাটকে সোনালি আঁশ বলা হতো। কালের বিবর্তনে, আমাদের ভ্রান্ত পাটনীতির কারণে এবং দুর্নীতি লুটপাটের শিকার হয়ে পাট হয়েছিল কৃষকের গলার ফাঁস। মূলত পাটের ন্যায্যমূল্যের অভাবে স্বাধীনতা-উত্তর পাটচাষিরা পাটের চাষ ছেড়েই দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পাকিস্তান আমলে পাটের যে কতটা কদর ছিল, তা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আবার আমার চোখের সামনে পাটের সুদিনও হারিয়ে যায়। দেশে স্থাপিত পাটকলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল। অথচ কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় পাটকলগুলো দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষ্ট না হলে হয়তো পাটের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতি স্বাবলম্বী হতে পারত। স্বাধীনতার পরপর পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আসত রফতানি আয়ের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। অথচ সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিককে কাজ হারাতে হয়েছিল। এমনকি বিএনপি সরকার বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী একপর্যায়ে বন্ধ করে দেয়। ফলে চিরচেনা পাটকল থেকে চোখের পানি ফেলে বিদায় নিতে হয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীকে। যে মুহূর্তে বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল ধ্বংস করা হয়েছে, সে মুহূর্তে প্রতিবেশী ভারতে পাটশিল্পের অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। ভারত এখন পাটশিল্পে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বের মানচিত্রে।

আমাদের দেশে চাষিরা যেটুকু পাটচাষ করেছে, তা দেশীয়ভাবে বিক্রির তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় সেই পাট দেদার পাচার হয়েছে ভারতে। এখন আমাদের দেশের পাটচাষিরা পাটের ভালো দাম পাওয়ায় পাটচাষের আগ্রহও বাড়তে থাকে। আবার এরই মধ্যে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে পাটের চাষাবাদ বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে। ‘পণ্যে পাটজাত মোড়ক’ কর্মসূচি গ্রহণ করে পরিবেশ বিধ্বংসী প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে পাটের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু হয়েছে। যদিও স্বাধীনতা-উত্তর দীর্ঘ সময়ে পণ্যের মোড়কে প্লাস্টিক, সিনথেটিক ও পিপি ব্যাগের ব্যবহার যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ইচ্ছা করলেও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। ইতোমধ্যে দেশে পাটের বদলে পলিথিন, সিনথেটিক, পিপি ব্যাগ প্রস্তুতে ছোট-বড় কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এ খাতে ব্যাংকের পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। হঠাৎ গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান যেমন একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কারখানা বন্ধ করতে না পারলে সরকার পণ্যে পাটজাত মোড়কের শতভাগ ব্যবহারকেও নিশ্চিত করতে পারবে না। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তবতা।

 

ইতোমধ্যে সরকার চালসহ ১৭টি পণ্যে পাটজাত মোড়ক নিশ্চিত করতে আইন করে কার্যকরের চেষ্টা করছে। শুধু চালের ক্ষেত্রেই নয়— চিনি, আটা, সার, মশলা জাতীয় পণ্যের পাটজাত মোড়ক ব্যবহারের আইন করলেও তা শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি পলিথিন, সিনথেটিক ও পিপি ব্যাগ প্রস্তুত প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন হবে। এজন্য পর্যায়ক্রমে পরিবেশ বিধ্বংসী এসব পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যাংক কিংবা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া পাটজাত পণ্যে মোড়কের ব্যবহার বাড়াতে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের ব্যবস্থা করে পাটের মোড়ক প্রস্তুতের জন্য যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তা না করলে মোড়কে পাটজাত পণ্যের শতভাগ ব্যবহার বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

অবশ্য এখন পাটপণ্যের ব্যবহার গোটা বিশ্বে ফিরতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সচেতন মানুষ পরিবেশ বিধ্বংসী প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার দিনে দিনে কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশেও এখন সেই হাওয়া লেগেছে। একসময় বাংলাদেশের পাটের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল ভারত, চীন ও পাকিস্তান। বর্তমানে সেই বাজার বিস্তৃত হয়েছে প্রায় ৬০টি দেশে। আবার নতুন নতুন বাজারের সন্ধানও মিলছে। সবমিলিয়ে এখন পাটের সুদিন ফিরতে যে শুরু করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পাটের ওপর নিরবচ্ছিন্ন গবেষণায় পাটের জিন উদ্ভাবন করতে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হয়েছেন। এখন পাট থেকে প্রায় ২৮৫ ধরনের পাটপণ্য দেশে-বিদেশে বিক্রি হচ্ছে।

সরকার ১৭টি পণ্যে মোড়কজাতের ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ বাস্তবায়ন করায় পাটের বস্তার অভ্যন্তরীণ বাজার বেড়েছে কয়েকগুণ। এ আইনের শতভাগ প্রয়োগকে নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরিবেশ বিধ্বংসী সিনথেটিকের আগ্রাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। শুধু তা-ই নয়, পাট থেকে মিহি কাপড় তৈরির গবেষণায় দেশের বিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। এমনকি স্বাস্থ্যসম্মত পাট-পাতার তৈরি চা রফতানি শুরু হয়েছে জার্মানিতে। হয়তো পাটের পাতার চা গোটা বিশ্বে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে। বর্তমানে পাটের তৈরি ব্যাগের কদর গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য পাটজাত পণ্যের বাজার প্রতিনিয়তই সম্প্রসারিত হচ্ছে। মনে হয়, একসময়ের ‘সোনালি আঁশ’ আবার সম্ভাবনার ভাগ্য দুয়ারকে খুলে দিতে পারে।

আমাদের ছোট্ট দেশটির জনসংখ্যার চাপ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সুতরাং এখন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। যখন পাটের চাষাবাদ আরো বৃদ্ধি পাবে, তখন ধানের চাষাবাদের পরিমাণ কমে আসবে। ফলে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে পাট বিজ্ঞানীরা লোনা পানি সহনীয় জাতের পাট উদ্ভাবনে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা আশাবাদী, এ জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব হলে পাট চাষের জন্য নতুন পরিধি নিশ্চিত হবে। তখন আর ধান-গমসহ কৃষিপণ্য চাষাবাদের ওপর নেতিবচক প্রভাব পড়বে না। মোদ্দাকথা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে পর্যাপ্ত রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও বিশ্ববাজারে এ খাতের রফতানির পরিমাণ সম্প্রসারিত হচ্ছে। মানুষ এখন আশাবাদী, এক সময়ের সোনালি আঁশের সুদিন আবার ফিরে আসবে, সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads