• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আত্মহনন : শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক

কেন এই আত্মহনন?

প্রতীকী ছবি

মতামত

ভিন্নমত

আত্মহনন : শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক

  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অনি আতিকুর রহমান

সহস্র প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের স্থান করে নিতে হয় একজন শিক্ষার্থীকে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আকাশসমান এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে কত রাতের ঘুম জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে, সেটা শিক্ষার্থী মাত্রেই জানে। সব বাধা পেরিয়ে যখন লক্ষ্যে পৌঁছায়, শিক্ষার সর্বোচ্চ উঠানে পা রাখে, তখন পরিবার দেশ জাতি তার কাছ থেকে বহু কিছুই আশা করে। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী যখন শিক্ষাজীবন শেষ না করেই লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে, তখন সেটি হয় কষ্টের। আর সেই মৃত্যু যদি হয় ‘আত্মহনন’ সেটি আরো বেশি নাড়া দিয়ে যায়।

কেন এই আত্মহনন? প্রশ্নটি মনে আসতেই কতগুলো পরিচিত উত্তর : বেকারত্ব, অবসাদ, অসম প্রেম-ভালোবাসা, জটিল ব্যাধি কিংবা পারিবারিক কলহ ইত্যাদি। একসময় আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যেত শুধু গ্রামীণ দরিদ্র সমাজে। কিন্তু এটি বর্তমানে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কিংবা নানা অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের পর্যালোচনার বিষয় হলো আধা প্রতিষ্ঠিত সমাজ। ‘আধা প্রতিষ্ঠিত’ বললাম, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেই দেশের বড় বড় পদে আসীন হয়ে দেশকে সেবা দেবেন। কিন্তু এই গ্র্যাজুয়েটই যখন সামান্য ডিপ্রেশন কিংবা সম্পর্কের দৈন্যে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে, তখন তার অর্জিত বিশাল শিক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। আর যখন শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন, তখন এর দায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপরও বর্তায়। যদিও এতে ব্যক্তির নিজের, পিতা-মাতার এবং বন্ধুদেরও দায় কম নয়। কেননা আশপাশের মানুষগুলো একটু সচেতন হলেই আত্মহত্যায় উদ্যত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব। আত্মহত্যার আগে একজন মানুষের চিন্তাগত, আবেগগত, আচরণগত ও মানসিক পরিবর্তনের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক খসখসে। শিক্ষকদের অধিকাংশই তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারছেন না কিংবা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাষ্ট্র শিক্ষককে বেতন দেয়; বিনিময়ে শিক্ষক কয়েকটি ক্লাস ও পরীক্ষা নেবেন। ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসা; গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখা কিংবা সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করার কোনো বালাই নেই। অথচ ২০০১ সালে প্রকাশিত গেজেটে ৩৫ নম্বর ধারার ২(গ)-তে শিক্ষকদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ছাত্রদের সহিত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করিবেন, তাহাদিগকে পথ নির্দেশ দিবেন এবং তাহাদের কার্যক্রম তদারক করিবেন।’

বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন দুই ধরনের শিক্ষক বেশি দেখা যায়। এক. যারা নতুন বর্ষের কোর্স বণ্টনের পর এক-দুই মাসের মধ্যেই ৮-১০টি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করেন। তারা শ্রেণিকক্ষে যাদের পড়িয়ে গেলেন, বিভাগের করিডোরে কিংবা পথিমধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা হলে আর চিনতে পারেন না। কিংবা কোনো শিক্ষার্থীর নামও মনে রাখেন না। দুই. যারা সারা বছর ক্লাস নেবেন না; কিন্তু পরীক্ষা শুরুর মাসখানেক আগে শিক্ষার্থীদের ম্যারাথন ক্লাস করাতে বাধ্য করেন। পরে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ছাত্রদের দিয়েই বিগত সালের প্রশ্ন থেকে সাজেশন তৈরি করিয়ে নিয়ে প্রশ্ন আউট করে দেন। কী সহজ পাঠদান পদ্ধতি! দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দুই ধরনের সংখ্যাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন বেশি। ফলে এসব শিক্ষক তাদের শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি কখনোই যেতে পারেন না। জানতে পারেন না তাদের মনের কথা।

কিন্তু এর বাইরে আরেক শ্রেণির শিক্ষক রয়েছেন, যারা ক্লাসে নিয়মিত আসেন, ভালো পড়ান। কিন্তু তাদের গগনচুম্বী ব্যক্তিত্বের কাছে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়া জিজ্ঞেস করতেও সাহস করে না। ফলে এ ধরনের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে। এত কথার পরেও ‘আদর্শ শিক্ষক’ বলতে যা বোঝায়, তাদেরও অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। তবে উপর্যুক্ত তিন ধরনের শিক্ষকের ভিড়ে তাদের সংখ্যা অনেকটাই ম্লান। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের কষ্টের কথা, অভিমানের কথা, দুঃখের কথা কিংবা বিষাদের কথা শিক্ষকদের কাছে বলতে পারে না। ফলে সামান্য ঘটনায় অকালে ঝরে যায় মেধাবী প্রাণগুলো।

অতিসম্প্রতি দেশের এক প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মাস্টার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ছেলেটি ক্লাসে প্রথম। মেয়েটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক অধ্যাপকের কন্যা। তাদের প্রেমের সম্পর্কের টানাপড়েন পরিবারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্ক মেনে নিতে না পারা। তাই তারা আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তাদের এ ঘটনা কোনো শিক্ষক যদি জানতেন, তিনি কি পারতেন না তাদের মোটিভেট করতে?

একটা পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করতে চাই, বাংলাদেশে এক বছরে প্রতি লাখে ২৮১ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং ১২৮ জন মারা যায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী এবং অবিবাহিত। আর গত এক বছরে সারা দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। আত্মহত্যা হলো একটি সুন্দর জীবনের করুণ পরিণতি। নিজের গণ্ডিতে শিক্ষার্থীর এক সুন্দর জীবনের করুণ পরিণতির জন্য শিক্ষকরা কি পারবেন পেশাগত কিংবা নৈতিক দায় এড়াতে?

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads