• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
স্বাধীন মতপ্রকাশের অন্তরায়

সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ অস্ত্র ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮

স্বাধীন মতপ্রকাশের অন্তরায়

  • সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন
  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০১৮

ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারব না; কিন্তু আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার যে অধিকার আপনার আছে, সে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন হলে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’

বহুমাত্রিক দর্শনের এই মহত্তম কবি ১৭শ’ শতকে ফরাসি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভলতেয়ার ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সংস্কার যুগের অন্যতম স্রষ্টা। ভলতেয়ারের বিখ্যাত এই উক্তি তখন থেকেই মানবিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। বহুমাত্রিক তত্ত্বের এই উক্তিটির সারমর্ম হলো— মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক্স্বাধীনতা। আমরা জানি, সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র। যার জন্য সংবাদপত্রকে গণমাধ্যমও বলা হয়ে থাকে।

বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ারের এই নিষ্কণ্টক উক্তির উদ্ধৃতি তুলে ধরছি বাংলাদেশে সংবাদপত্রের টুঁটি চেপে ধরা কিছু আইন-কানুন নিয়ে আলোচনার জন্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সরকার একের পর এক সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ না দিয়ে সঙ্কোচনের পথই তৈরি করেছে। পাশাপাশি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য চলেছে নানান হীনকর্ম। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক সংবাদপত্র, হত্যা করা হয়েছে সাংবাদিকদের। সেসব ঘটনার কোনোটিরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। যে কারণে হামলা, মামলা আর নির্যাতনের ভয়ে দেশের সংবাদপত্র জগতে চলছে এখন ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। ‘বলেছেন, করেছেন, উদ্বোধন, উন্নয়ন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, গুজব-রটনা’- এসব ছাড়া স্বাধীন সাংবাদিকতার অনুসন্ধানী সংবাদের চিত্র এখন বিলুপ্তির পথেই বলা যায়। মাঝেমধ্যে দু’একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এলেও এর চাপ সইতে সইতে সম্পাদক প্রকাশকদের বুক মাটিতে লেগে যায়। (অফ দ্য রেকর্ডে— বিশেষ কর্তৃপক্ষকে জবাব দিতে দিতে নাজেহাল হতে হয়।) যে জন্য এসব নিয়ে সম্পাদক ও মালিকদের অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ প্রবাদের মতোই।

অন্যদিকে বর্তমান সরকারের দুই দফা মেয়াদে নতুন নতুন অনেক গণমাধ্যমকে ছাড়পত্র (ডিক্লারেশন) দেওয়া হলেও তা দেওয়া হয়েছে বিশেষ আনুকূল্য আর অনুগত শর্তসাপেক্ষে। ফলে সংবাদপত্র জগতে আরো শক্ত শিকড় গেড়ে বসেছে সেলফ সেন্সরশিপের সাংবাদিকতা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে পরিমাণ অপরাধের ঘটনা ঘটছে তার সিকিভাগও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে না সেলফ সেন্সরশিপের কারণে। দেশবাসী জানতে পারছে না প্রকৃত অপরাধের চিত্র।

সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ অস্ত্র ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’। এই আইনের ৩২ ধারার মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার অনুসন্ধানী কার্যক্রমকে পুরোপুরি কব্জা করা হয়েছে। অনুসন্ধানী কাজের প্রতিটি স্তরেই নিরাপত্তার নামে প্রতিবন্ধকতা, বাধা, অনুমতি, অবহিতসহ বিভিন্ন অজুহাতের ছলে গ্যাঁড়াকলে আটকে রাখা হয়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে। যে জন্য তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে একজন অপরাধীর প্রকৃত অপরাধের চিত্র উন্মোচন কঠিন বা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। নিরাপত্তার অজুহাতে স্বাধীন সাংবাদিকতায় এই আইনি প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে অপরাধীকে আরো প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে— এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পর থেকে দেশের গণমাধ্যম জগতে যেমনি ক্ষোভ বিরাজ করছে, তেমনি রয়েছে আতঙ্ক আর উদ্বেগও। এই আইন যে শুধু স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা তা নয়, সাংবাদিকদেরও নিপীড়নের মুখে পড়তে হবে। কোনো প্রকার পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো ব্যক্তিকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বলেই শঙ্কিত এখন গণমাধ্যম কর্মীরা।

এই আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।’

আইনে বলা হয়েছে, ‘কেউ যদি বেআইনিভাবে কারো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আবার কেউ যদি বেআইনিভাবে কারো ডিভাইসে প্রবেশ করে, তাহলে এক বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কেউ যদি কারো ডিভাইসে প্রবেশে সহায়তা করে, তাহলে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।’

আমরা জানি, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি। অর্থাৎ গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা। একজন অপরাধী ও অপরাধীর স্বজন যেমন সহজে তথ্য দিতে চায় না, তেমনি আবার অপরাধীর ভয়ে ভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিবেশী বা প্রত্যক্ষদর্শীও তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আমাদের সমাজে অপরাধীর প্রতি সাধারণ মানুষের এই ভীতি অপরাধীকে আরো প্রভাবশালী করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। দেশের অপরাধ জগতের সব ক্ষেত্রেই যখন এমন চিত্র, সেখানে অপরাধ অনুসন্ধানে গুপ্তচরবৃত্তির বিকল্প নেই। তা ছাড়া একজন অপরাধী বা প্রভাবশালী ব্যক্তির অপরাধের তথ্য একজন সাংবাদিক সবার প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ায় কখনোই উন্মোচন করতে পারেন না। সেখানে সাংবাদিকের জীবন ও পরিবারের জন্য হুমকি থাকেই। বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা-ই স্বাধীন সাংবাদিকতার এই অনুসন্ধানী কাজকে আইনি বিধি-নিষেধে মুড়িয়ে অসার করে ফেলেছে। এ আইন দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিকলাঙ্গ করেছে— এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

চলতি বছরের গত ২৯ জানুয়ারি সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পর থেকে দেশবরেণ্য সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক ও বিভিন্ন সচেতন পেশাজীবীরা এই আইন সংশোধনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে আহ্বান জানালেও কার্যত কোনো ফল আসেনি। সবার দাবিকে উপেক্ষা করে আইনটির দুয়েকটি ধারায় কয়েকটি শব্দের পরিবর্তন এনে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে আইনটি পাস করা হয়। এর আগে দেশের রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা এই আইন নিয়ে সরকারকে উদ্দেশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা বলেছেন, এই আইন সব ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি করবে।

দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৫৭ ধারার চেয়েও বিপজ্জনক। এটি সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, ‘৩২ ধারা সাংবাদিক, লেখকসহ তথ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত করবে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্তির ঘোষণা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় আইসিটি আইনের অনুরূপ বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। এই আইন নাগরিকের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি করবে।’ দেশের নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ওই মানবাধিকার সংগঠন।

এই আইনে বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকর হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হবে। তবে এই আইনটিতেই বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো চারটি ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশকে পরোয়ানা এবং কারো অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনে ঢোকানো হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের সমালোচিত আইন ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’। আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এই আইন লঙ্ঘন হয়- এমন অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।

এ ছাড়া এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ে সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস সময় বাড়ানো যাবে। আইনে বলা হয়েছে, তথ্য অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর বিধানাবলি কার্যকর থাকবে।

এই আইন নিয়ে বিরোধী দলের কয়েক সদস্যও বেশকিছু ধারা নিয়ে আপত্তি তোলেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ১১ জন ও স্বতন্ত্র একজন সংসদ সদস্য বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই ও আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিরোধী দলের অপর এক সদস্য বলেছিলেন, অংশীজনদের আপত্তি ও বিতর্কিত ধারাগুলো অপরিবর্তিত রেখে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা খুবই উদ্বেগজনক। বিতর্কিত ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ অনুসরণের সুপারিশ করার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।

এতসব আপত্তির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠন— সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও দুই দফা বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব আপত্তিও সরকার মনে রাখেনি। এত কিছুর পরও গণমাধ্যম ও দেশবাসীর পক্ষে আমরা সরকারের প্রতি বিনয়ী আবেদন করছি— গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে স্বাধীন মতপ্রকাশের কোনো বিকল্প নেই। কারণ স্বাধীন মতপ্রকাশেই ত্রুটি চিহ্নিত হয়, সেখান থেকেই সংশোধনের সুযোগ আসে। আর তাতেই দেশের উন্নতি। আমরা চাই সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে স্বাধীন মতপ্রকাশের আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে।

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads