• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি নিয়ে কিছু কথা

পরীক্ষার পূর্বে টেনশন হবেই, এটিই স্বাভাবিক

আর্ট : রাকিব

মতামত

শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি নিয়ে কিছু কথা

  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০১৮

মাসুম বিল্লাহ

পরীক্ষাভীতি যেকোনো ধরনের এবং যেকোনো বয়সের শিক্ষার্থীদের কাছে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কারো ক্ষেত্রে ভীতিটি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, শরীর ও মনে প্রচণ্ড অস্বস্তি বিরাজ করে। ফলে পরীক্ষায় যেসব উত্তর দিতে পারার কথা, সেগুলোও গোলমেলে হয়ে যায়। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা খাওয়া-দাওয়া, গোসল করা ছেড়ে দেয়। এক্ষেত্রে বাবা-মা, ভাইবোন ও শিক্ষকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের বুঝতে হবে, খাওয়া-দাওয়া করলে, ঘুম না হলে, গোসল না করলে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয় তা তাদের পরীক্ষার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শরীর ও মনের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। শরীর খারাপ হলে মনও খারাপ হবে। আবার মানসিক স্বস্তি না থাকলে শরীর খারাপ হতে বাধ্য। আর শরীর বা মন যেকোনো একটি খারাপ হলে পরীক্ষা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে শরীর, মন ও প্রস্তুতির মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন। কাজেই পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে হলে, পরীক্ষায় ভালো করতে হলে পরীক্ষার পূর্বে শরীর ও মন অবশ্যই ভালো রাখতে হবে। পরীক্ষাভীতির কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা এগুলো ছেড়ে দেয় বা অনিয়মিতভাবে করে থাকে। ফলে তাদের শরীর ও মনের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর তার ফলে অনেক জানা বিষয়ও তারা ভুল করে থাকে। কাজেই পরীক্ষাভীতি কীভাবে জয় করা যায় সে চেষ্টা আমাদের চালাতে হবে।

প্রথমত, নিয়মিত পাঠ শেষ করা, নিয়মিত পাঠ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যাবলি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে পরীক্ষাভীতির প্রধান ও মোক্ষম ওষুধ। বছরের শুরুতে এবং প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করা হলে পরীক্ষার সময় বেশি চাপ থাকে না, ফলে ভীতি অনেকটাই কমে যায়। পড়া জমিয়ে রাখলে টেনশন বাড়ে এবং তা অসহনীয় হয়ে ওঠে পরীক্ষার পূর্বে। এ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করে ফেললে পরীক্ষা নিয়ে মানসিক চাপ থাকে না, ফলে শরীর ও মন থাকে প্রফুল্ল।

নিয়মিত কাজ করার পরও যে একেবারে টেনশনমুক্ত থাকা যাবে পরীক্ষার পূর্বে বিষয়টি এমন নয়। পরীক্ষার পূর্বে টেনশন হবেই, এটিই স্বাভাবিক। পরীক্ষার পূর্বে বিদ্যালয়ে আনন্দঘন পরিবেশে পরীক্ষার বিষয়ের ওপর শ্রুতিপাঠের আয়োজন করা যেতে পারে। জানা-অজানা কুইজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আনন্দ-হাসিতে মেতে উঠবে। পরীক্ষার পূর্বে বিদ্যালয়গুলো এ ধরনের কর্মকাণ্ডের আয়োজন করলে শিক্ষার্থী তথা পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যাবে। নতুনভাবে তারা উজ্জীবিত হবে। অভিভাবকদের সঙ্গে সভা করে তাদের মত বিনিময় করা যেতে পারে, যাতে তারা পরীক্ষার্থীদের খাবার, নিয়মিত কাজগুলো ঠিকমতো করার তাগিদ দেন ও ব্যবস্থা করেন। বাসায় টিভির অনুষ্ঠানগুলো লাগামহীনভাবে না দেখে বরং তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গ দেবেন। 

পরীক্ষার সময় ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন প্রশ্নের উত্তর কখন দিতে হবে, কত সময়ের মধ্যে দিতে হবে— তার রিহার্সেল এবং  মক টেস্ট আগে দিলে মূল পরীক্ষার ভীতি কমে যাবে। কারণ শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে তাদের কোন প্রশ্নে কত সময় লাগবে। সময় তাদের হাতে, তারা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে পরীক্ষার পুরো সময়। তাই পরীক্ষার পূর্বে শ্রেণিকক্ষে কিছু মক টেস্টের আয়োজন করা যেতে পারে। আমাদের বিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টারগুলো অবশ্য অনেক পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে মূল পরীক্ষার পূর্বে। এই পরীক্ষাগুলো অবশ্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার স্বাদকে তেতো করে ফেলে। এসব পরীক্ষা দিতে দিতে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাদের শরীর ও মন পরীক্ষার পূর্বেই বিষিয়ে ওঠে। এ ব্যাপারটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি সমর্থন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী একটা বিষয় পড়ার পর সে কী শিখল তা যাচাই করার জন্য একটি ভালো পদ্ধতি হলো তাকে কিছু লিখতে বলা। এখন তারা যা শিখছে এবং যে পদ্ধতিতে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তাতে আমরা ফলাফলের ঊর্ধ্বগতি বা ফল বিস্ফোরণ দেখছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, ফলাফলের এ বিস্ফোরণের সঙ্গে মানের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, ‘সৃজনশীল নামটাই শুধু আকর্ষণীয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক যে বিপর্যয় এবং মনের ক্ষেত্রে যে ধস নেমেছে তার পেছনে এটি অন্যতম কারণ। যা ইচ্ছা তাই লিখলেই সৃজনশীল বলে নম্বর দিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার নামে যেসব প্রশ্ন করা হয় তা বিভ্রান্তিকর এবং বিদ্ঘুটে। এসব বিষয় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষক নোট গাইড ব্যবহার করছেন অথচ শিক্ষার্থীদের তা ব্যবহার করতে নিষেধ করছেন। এই দ্বিমুখিতাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি বাড়াচ্ছে।’

সৃজনশীলতা মানে শিক্ষার্থীদের হুবহু কিছু মুখস্থ করতে হবে না, নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেবে যা ছিল আনন্দের বিষয়। তার পরিবর্তে এখন বেড়ে গেছে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক ও শিক্ষকদের টেনশন। সৃজনশীলের আওতা যতই বাড়ছে ততই বাড়ছে নোট-গাইড ও কোচিং নির্ভরতা। আর তা শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেওয়ার পরিবর্তে বাড়িয়ে দিয়েছে ভয়, মনে সৃষ্টি করছে সন্দেহ এবং এসবই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি দিনকে দিন বাড়িয়ে তুলছে। এ থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads