• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন

আর্ট : রাকিব

মতামত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

  • অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  • প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০১৮

গত ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পার্লামেন্টে পাস হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। আইনটি প্রস্তাবের পর থেকেই সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। এখন আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি এবং এর অপব্যবহার হতে পারে বলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশন টক শো ও পত্রিকার কলাম পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।

এ আইনটিতে মোট ৪৮টি ধারা আছে। এর মধ্যে ১৭ থেকে ৪৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে— সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে সেই ব্যক্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নতুন এ আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ আরো কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, ছবি তোলা, ভিডিও করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে বেআইনি শব্দটি ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ এবং ফটো বা ভিডিওচিত্র ধারণকে বন্ধ করাই উদ্দেশ্য। এ ধরনের কাজকে গুপ্তচরবৃত্তি বা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে তথ্য সংগ্রহের কাজটি আরো কঠিন করে ফেলা হয়েছে। এটা মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এতে করে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকবে এবং মুক্ত আলোচনা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচনা করতে আর সাহস পাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নতুন আইনের ১৮ ও ১৯ ধারায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিনা অনুমতিতে অফিসে ঢুকে কেউ যদি তথ্য নেন, সে জন্য অন্য আইন আছে। কেউ যদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ফাইল পাচার করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’ আছে। কিন্তু নতুন আইনে আবার তা পুনঃপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। ফলে কোনো সাংবাদিক এখন আর ‘স্টিং অপারেশন’ চালিয়ে ঘুষ বা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ যদি কোনো সরকারি বা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হন আর তা যদি তিনি তার মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে আনেন, তবে তা প্রকাশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ ঘুষ খেলেও তার তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। তার মানে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি এখন সুশাসনের বিপক্ষে। আর সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে অসুবিধার মুখে পড়বে।

তবে এ আইনের অনেক ভালো দিকের অন্যতম হচ্ছে— দেশকে অপপ্রচার থেকে রক্ষা করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রসার ঘটানো। আইনের ২১ ধারার ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদত দিলে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড রাখা হয়েছে। আর ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রচার বা প্রকাশ করলে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বেআইনিভাবে কারোর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এ ছাড়া বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয় দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখান, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

নতুন আইনের ভালো দিকের আরেকটি হচ্ছে, অনলাইনে কেনাকাটাকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কেউ যদি কোনো ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে তাকে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে তাকে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হতে পারে। এই আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারার সব অপরাধ জামিন অযোগ্য। তবে ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৮ ধারার সব অপরাধ জামিনযোগ্য।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি সরকারের সময়ে তারা কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, কখনো শিকার হচ্ছেন হয়রানির। আর এসব ঘটছে কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়্গ। হামলা, মামলা আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য গণমাধ্যমের যেমন নিরপেক্ষতা দরকার। তেমনি স্বাধীনভাবে কাজ করার যাবতীয় সুবিধাও দিতে হবে। তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার গতি আরো ত্বরান্বিত হবে। আর সুশাসন সমুন্নত অবস্থানে পৌঁছলে গণমাধ্যম বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ জন্য নতুন আইনে মিডিয়াকে সুরক্ষা দিতে হবে।

সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্যসব আইনে যা-ই থাক, সংবিধানের আইনই অগ্রাধিকার পাবে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২ নম্বর ধারায় কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ৩২ ধারা এই অনুচ্ছেদ ও ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, ধারাটি সুগ্রন্থিত নয়, অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, অপব্যবহারযোগ্য, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং সর্বোপরি সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং এ আইন জনস্বার্থ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম- এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

seraj.pramanik@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads