• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বিশ্ব শিক্ষক দিবস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

সৃষ্টির সেরা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বা বিবেক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০১৮

মোঃ কায়ছার আলী

‘যাদের নাই এমপিও, শরীরে থাকে না গেঞ্জিও।’ ‘বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন, পেতে বড়ই টেনশন।’ আজ ৫ অক্টোবর WORLD TEACHERS DAY. ১৯৪৬ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা, অধিকার এবং আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক সনদ নামক একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃসরকার সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখটি অর্থবহ ও স্মরণীয় করে তোলার লক্ষ্যে ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ২৬তম অধিবেশনে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে UNESCO বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রচলন করে। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ১০০টি দেশের সঙ্গে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে যথাযথ মর্যাদা, তাৎপর্য ও গুরুত্বসহকারে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। EDUCATION INTERNATIONAL-এর সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন এ দিবসটি পালনে মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ই.আই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের ধ্যান, ব্রত, সাধনা বা মহান পেশার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য The right to education means the right to a qualified teacher. সৃষ্টির সেরা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বা বিবেক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষার আলো ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করেন সম্মানিত শিক্ষক সমাজ বা মহান শিক্ষকরা। আমরা সাধারণ, কিন্তু তৈরি করি অসাধারণ। ধূপের মতো গন্ধ বিলিয়ে এবং মোমবাতির মতো নিজেকে জ্বালিয়ে আমরা তৃপ্তি পাই। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯০ শতাংশ তথা ছাত্রসমাজের শিক্ষার জন্য যে স্কুলের দরজা খোলা থাকে, তা হলো এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা। দীর্ঘসময় ধরে এমপিওভুক্ত না হলে, কমিটি দ্বারা হয়রানির শিকার হলে বা কর্মরত অবস্থায় অসুস্থ, মৃত্যুবরণ করলে বা অবসর গ্রহণের পরে দীর্ঘদিন যাবৎ অবসর ভাতা ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ না পেলে একজন শিক্ষকের পরিবার যে চরম আর্থিক অবস্থার শিকার হয় তা মনে পড়ে যায় বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক, খ্যাতনামা লোকসাহিত্য গবেষক ও জীবনবাদী কবি আশরাফ সিদ্দিকী রচিত ‘তালেব মাস্টার’ কবিতার সারমর্মখানা উপলব্ধি করলে।

তালেব মাস্টারের কথা ইতিহাস হয়তো লিখে রাখবে না। তালেব মাস্টার যেন সে-ই বাতিওয়ালা, যে পথে পথে আলো জ্বালায়, কিন্তু নিজের ঘরে আলো জ্বালাবার কেউ নেই। সময়ের ব্যাপক পরিবর্তন হলেও আজ এ দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বহুজাতিক কোম্পানির কেরানি হতে চায়, কিন্তু শিক্ষক হতে চায় না। বহুজাতিক কোম্পানিতে বহুমুখী যে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। তা শিক্ষকের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলভুক্ত করে বেতনের ৫০ ভাগ সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে মূল বেতনের শতকরা ১০০ ভাগ, বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ, চিকিৎসা ভাতা দ্বিগুণ, উৎসব ভাতা (শিক্ষক ২৫ শতাংশ ও কর্মচারী ৫০ শতাংশ) এবং অবসরে আর্থিক সুবিধা বর্তমানে শিক্ষকরা বিলম্বে পেয়ে থাকেন। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বিগত আট বছর ধরে সরকার ১ জানুয়ারিতে (মাধ্যমিক ও সমমানসহ) বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ (২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩০২টি) এবং ক্লাস শুরু (১ জুলাই কলেজ) জাতীয় শিক্ষানীতি/১০ প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ, ২৩৩০০ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, উপজেলায় আইসিটি রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ, পশ্চাৎপদ অঞ্চলে ইংরেজি ও গণিতে ১১ লাখ অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি, ৬০ দিনে সব পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ, শ্রেণিতে মানসম্পন্ন পাঠদানের সিডি (CD) প্রদান, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মাদরাসার মূল ধারার সঙ্গ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি বা আধুনিকায়ন, ২০১৫ সালের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা এবং ১০ লাখ শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইতোমধ্যে সমাপ্ত করেছে। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্যের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস না লিখলে বড় অন্যায় হবে, ভুল হবে আর তা হলো ২৬১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গত ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারিতে বর্তমান সরকার জাতীয়করণ করে হাজার হাজার সোনার হরিণ (সরকারি চাকরি সোনার হরিণের মতো) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রদান করার কথা। তাই বর্তমান সরকারের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন তাদের পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য। বর্তমান সরকারপ্রধান অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে ২০১৮-১৯ সালে ৪৬৪৫৭৩ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রণয়ন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছেন।

গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, নিউজ ডেস্কে প্রকাশিত ‘শিক্ষকের সম্মানে লালগালিচা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে জানতে পারলাম ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করতে যান শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। তিনি শেখ হাসিনার শিক্ষক। আর সে অনুষ্ঠানেই ছাত্র-শিক্ষকের চির অমলিন শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ককে সম্মান দেখিয়ে নিজ শিক্ষকের জন্য লালগালিচা ছেড়ে হাঁটার অনন্য নজির স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সম্মান প্রদর্শন দৃশ্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃষ্টান্তকে অনুকরণীয় বলে মত সবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হয়ে নিজের শিক্ষাগুরুকে সামনে পেয়ে সম্মান দিতে ভুলে যাননি শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বলেই হয়তো এমন বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হতে পারল গোটা জাতি। পরিশেষে সাড়ে ছয় কোটি শিক্ষা পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি (অনুরোধ বা দাবি একটা চলমান প্রক্রিয়া) নিকট অতীতের মতো যত দ্রুত সম্ভব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো (স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা) জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে আপনার নাম ইতিহাসের পাতায় (প্রাথমিকের মতো) স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করবেন। তখন আমরা সারা দেশের শিক্ষকসমাজ কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার কালজয়ী শেষ উক্তিখানা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বলতেই থাকব ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads