• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
শিক্ষা ও শিক্ষক দিবস

শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তিনিই শিক্ষক

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শিক্ষা ও শিক্ষক দিবস

  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০১৮

মো. মনিরুল ইসলাম

বাঙালির একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ।’ কাগজে-কলমে আজকাল এত বেশি আন্তর্জাতিক দিবসের ছড়াছড়ি যে, তা বাঙালির এই প্রবাদকে ছাড়িয়ে গেছে। বছরের প্রতিটি দিন কোনো না কোনো দিবসকেন্দ্রিক আয়োজন থাকছে। ফলে নতুন ঘোষিত কোনো দিবস পৃথক দিন-তারিখ না পেয়ে পূর্ব ঘোষিত দিবসের সঙ্গে নিজেকে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। পালিত এসব দিবসের তাৎপর্য নেই এমন নয়, তবে এসব দিবসের তাৎপর্যের ফিরিস্তি বিশ্ব সভ্যতার তৃণমূল পর্যায়ে না পৌঁছালে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অধরাই থাকবে চিরকাল। শিক্ষকদের মর্যাদা ও ক্ষমতার স্বীকৃতি এবং তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে বছরের একটি দিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। মানুষ স্বভাবতই উদ্ভূত সমস্যা সমাধান চায়। সুতরাং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের মর্যাদা ও ক্ষমতার দীর্ঘদিনের যে দৈন্য তা সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সূত্রপাত তা বিশেষজ্ঞের কোটেশনে উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যায়। ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়। প্রতিবছরই দিবসটিতে শিক্ষকের মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। যেমন ২০১৬ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘শিক্ষকের মূল্যায়ন, মর্যাদার উন্নয়ন’, ২০১৭ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষকের ক্ষমতায়ন, স্বাধীনভাবে পাঠদান।’

শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তিনিই শিক্ষক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানদানের কাজে নিয়োজিতদেরই শিক্ষক বলা হয়। যে নামেই পরিচিত হন না কেন, শিক্ষকদের সাধনা অন্য দশটি চাকরির মতো নয় নিঃসন্দেহে। শিক্ষকতা মানেই হলো সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া সামাজিক-সংস্কৃতির দেশে শিক্ষকের দীনতা, অক্ষমতা, অমর্যাদা বেশ প্রকট। আমাদের দেশে যেকোনো পর্যায়ের শিক্ষককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন শিক্ষকতায় এসেছেন? খুব কম সংখ্যকই শিক্ষকতায় আসতে তাদের ভালোবাসা বা আগ্রহের কথা জানাবেন। অধিকাংশ শিক্ষকই বিকল্প রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা না পেয়ে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। অনাগত দিনের স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মান-মর্যাদার কথা ভেবে দেশের মেধাবীরা তাদের পছন্দের পেশার তালিকায় শিক্ষকতাকে তলানির দিকে রাখেন। জীবনের একটি বড় অংশ এবং শিক্ষাজীবনের পুরো অংশ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকলেও যাপিত জীবনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে নায়ক হয়ে উঠতে পারেন না। অথচ তিন ঘণ্টার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ক্ষমতাবানরা তাদের চোখে নায়ক বনে যান। মূলত শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পর্ব থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত শিক্ষকদের অসহায়ত্ব দেখে শিক্ষকতা পেশাকে তারা মর্যাদাকর মনে করে না। সুতরাং আমাদের দেশে একরকম বাধ্য না হলে শিক্ষকতায় কেউ আসতে চান না। অনেকে ভালোবেসে আগ্রহ নিয়ে শিক্ষকতায় আসেন, তবে সে সংখ্যাটি নিতান্তই কম।

ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। একই লক্ষ্যে আজ বাংলাদেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। শিক্ষক দিবসে এ ধরনের লক্ষ্যগুলো এদেশে কতটা পূরণ হয়েছে তা একটু পর্যবেক্ষণ করা দরকার। শিক্ষকদের যে অসামান্য স্বীকৃতির কথা ইউনেস্কো বলছে বাস্তবে আমাদের দেশে শিক্ষকতার সেই ব্রতকে অসামান্য ভাবা হয় কি না সে প্রশ্ন করাই যায়। দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কারে সাহিত্য, কৃষি, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, সমাজসেবা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আজ পর্যন্ত কেউ শিক্ষকতায় দেশের সর্বোচ্চ এই পুরস্কার পেয়েছেন- তা জানা নেই। একুশে পদক এমনকি বিভিন্ন জাতীয় একাডেমিক পুরস্কারের তালিকায় শিক্ষকতার জন্য শিক্ষকদের জায়গা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ শেষ জীবনে এসে শিক্ষা ব্যবস্থার কর্তাব্যক্তি হওয়ার দৌড়ে নামেন বটে, তবে তার জন্য তাকে নীল, সাদা, কমলা, কালো ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছাতার নিচে অবস্থান নিতে হয়। এসব ছাতার নিচে শিক্ষকতার চেয়ে দৌড়াদৌড়িই বেশি চোখে পড়ে!

সেই প্রাচীন আমল থেকে শিক্ষকতা মানেই অসচ্ছল জীবনের প্রতিচ্ছবি। আগের দিনে জায়গীর থাকা শিক্ষকরা পেটভাতার বিনিময়ে শিক্ষকতা করতেন। এখন অবস্থার একটু উন্নতি হলেও বৈষম্যের অন্ত নেই। এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খেয়ে পরে বাঁচেন বটে, তবে চিকিৎসা নামক হঠাৎ প্রয়োজনে অন্যের কাছে অসহায়ের মতো হাত পাততে হয়। সরকারি অন্যান্য পেশার কর্মকর্তারা যেখানে ইন্টারনেট ও মোবাইল খরচ পান সেখানে শিক্ষকদের এই সুবিধা নেই।

শিক্ষকদের এই দুর্দশার জন্য শিক্ষকরাও যে ধোয়া তুলসীপাতা নন তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষকদেরও প্রয়োজন আত্মসমালোচনা এবং আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া। দল চর্চা বা ক্ষমতা চর্চার বদলে শিক্ষকদের জ্ঞান চর্চাই বেশি মানানসই। নতুন প্রজন্মে জ্ঞানদানের পরিশুদ্ধ প্রতিশ্রুতিই হবে শিক্ষকতা ব্রতের অঙ্গীকার।

পরিশেষে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্যটি আবার সামনে নিয়ে আসি। নিশ্চয়ই শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টিকে সামনে আনতে ইউনেস্কো বিশ্ব শিক্ষক দিবসের কথা চিন্তা করেছিল। বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সমাজের জন্য এটিই একটি স্বীকৃতি। শিক্ষকদের জন্য দিবসটি অবশ্যই সম্মানের। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো, দিবসটি পালনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক খুব সামান্য আয়োজনই রয়েছে বাংলাদেশে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরাই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দিবস আড়ম্বরে পালন করেন। আরো আক্ষেপের বিষয়, অনেক শিক্ষক বিশ্ব শিক্ষক দিবসের খবরই রাখেন না। সম্মান ও মর্যাদার মাঠে গিয়ে শিক্ষকদের লড়াইয়ের অন্ত নেই, অথচ নিজের দিবসটি নিজেদের অঙ্গনেই তারা পালন করেন না। দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীও শিক্ষক দিবসের কথা জানে না। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের শেষ দিকে যখন চাকরিপ্রার্থী হয়, তখন সাধারণ জ্ঞানের বইতে শিক্ষক দিবসের কথাটি পরীক্ষায় পাসের জন্য শেখে! কিন্তু প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকরা দিবসটি পালন করতে পারতেন। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুরুভক্তির বিষয়টিও যেমন বাড়ত, আবার শিক্ষকদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের পরিধিটাও আরো বড় হতো। সুতরাং কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষকের সেই যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করা, আর শিক্ষক সমাজের সাধনা হবে সবসময়ই সুন্দরের শপথে বলীয়ান থাকা। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ভাষায়, ‘আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি/ শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার... যায় যাবে প্রাণ তাহে/ প্রাণের চেয়ে মান বড়...।’ এই হোক শিক্ষক দিবসের সাহসী প্রত্যয়। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে পৃথিবীর সব শিক্ষকের প্রতি জানাই সম্মান ও শ্রদ্ধা।

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads