• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বৈশ্বিক উষ্ণতায় জলবায়ুজনিত সঙ্কট

  • অলিউর রহমান ফিরোজ
  • প্রকাশিত ০৬ অক্টোবর ২০১৮

কয়েক দিন আগে একটি খবর দেখে হতবাক হলাম। জামালপুর জেলার একজন কৃষক হাহাকার করছেন। কারণ, তিনি নিচু জমিতে মরিচ চাষ করেছিলেন। হঠাৎ করেই ঢলের পানি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ভারতের কেরালা রাজ্যে বন্যার পর আমাদের দেশে আকস্মিকভাবেই পানি বাড়তে শুরু করে। এ পানিতেই তার জমি ডুবে যায়। সেই সঙ্গে তার জমি থেকে মরিচ তোলার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়। একজন প্রান্তিক কৃষকের তাই কান্না ও হাহাকার ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

বৈশ্বিক উষ্ণতায় বায়ুমণ্ডলে তাপ বৃদ্ধি পেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ এলোমেলো করে দিচ্ছে। অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে দেখা দিয়েছে হঠাৎ বন্যা। উজানের দেশ হিসেবে তার জন্য বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের কৃষিকে। আর তার আসল কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ুতে দেখা দিয়েছে বিরাট পরিবর্তন। তাতে করে প্রাকৃতিক পরিবেশও এখন বেসামাল হয়ে পড়ছে। বিশ্ব উন্নত হচ্ছে। তার সঙ্গে বাড়ছে নিত্যনতুন শিল্পায়ন। তাতে ব্যবহার হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। এর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ছে। তা ছাড়া জৈব প্রক্রিয়ায় বিশেষত ভূমি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসও গ্রিনহাউজ প্রভাব বৃদ্ধি করছে। তার কারণেই বন উজাড় হচ্ছে। ভূমির অপব্যবহার হচ্ছে। তাতে উদ্ভিদের কার্বন ডাই-অক্সাইডের শোষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পৃথিবী একটি গ্রিনহাউজের মতো। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও অপরাপর গ্রিনহাউজ গ্যাস সূর্যের আলোতে উত্তপ্ত তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকিয়ে রাখে। এর ফলে পৃথিবীর জীবনের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে।

যদি গ্রিনহাউজ প্রভাব না থাকত, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা থাকত মাইনাস ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বায়ুমণ্ডলে তাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ অনেক সময় আয়নার মতো কাজ করে থাকে। এর ওপর পতিত আলো ৯০ শতাংশ বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। আর যতটুকু অবশিষ্ট থাকে তার আবার ৯০ শতাংশ শোষণ করে পানি। পানি আবার এই তাপ শোষণ করে বরফ গলিয়ে দেয়। অপরদিকে প্রতিবছর মানবসৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৫০ শতাংশ শোষণ করে মহাসাগরের পানি। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এই পানি গরম হলে তা ক্রমহ্রাসমানভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং উপরিতল এবং গভীরতল পানির মিশ্রণে বাধা তৈরি করে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরো দ্রুততর হয়।

অপরদিকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে মিথেনের গ্রিনহাউজ তীব্রতা ২০ গুণেরও বেশি। সাইবেরিয়া অঞ্চলে ১০ বিলিয়ন টনের বেশি সঞ্চিত জৈববর্জ্য বিপুল পরিমাণ মিথেন ধারণ করে আছে। যা বর্তমান সময়ের মনুষ্যসৃষ্ট ৭০ বছরের গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের সমান। তাই সাইবেরিয়ার বরফ গলে যাওয়ার কারণে নির্গত মিথেন ধরে রাখার কোনো উপায় নেই। তাই এই মিথেন বায়ুমণ্ডলে আবার ফিরে যাচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি ১০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় গড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বরফ যুগের সঙ্গে উষ্ণ যুগের তাপমাত্রার পার্থক্য।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৭৫০ সালের আগে ছয় লাখ বছরের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১৮০ থেকে ৩০০ পিপিএম ছিল, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৩৭৯ পিপিএম; মিথেন ছিল ৩২ থেকে ৭৯০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন), ২০০৫ সালে তা হয়েছে ১৭৭৪ পিপিবি; নাইট্রাস অক্সাইড ছিল ২৭০ পিপিবি, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৩১৯ পিপিবি।

বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। মিথেন ও নাইট্রাসসহ অন্যান্য গ্যাস হিসাব করলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩০ পিপিএম কার্বন ডাই-অক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট। ধারাবাহিকভাবে এভাবে গ্যাস বৃদ্ধি থাকলে বায়ুমণ্ডলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৫০ থেকে ৭০০ পিপিএম কার্বন ডাই-অক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট এবং ২১০০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৫০ থেকে ১২০০ পিপিএম কার্বন ডাই-অক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট। গ্রিনহাউজ গ্যাসের এ প্রবণতা চলতে থাকলে ২১০০ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এমনকি তা বেড়ে ৪ ডিগ্রি থেকে ৬.৪ ডিগ্রিতে পৌঁছতে পারে। এমনিতেই পৃথিবী এখন উষ্ণতম সময় পার করছে। তার ওপর যদি শিল্পায়নের কবলে পড়ে গ্রিনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে, তাহলে মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা ঘটতে পারে।

২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমপক্ষে ১৮ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিমিটার এমনকি তা ২৬ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গড় তাপমাত্রা, তাপদাহ ও তীব্র বৃষ্টিপাত বাড়বে ব্যাপকভাবে। তা ছাড়া খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, টাইফুন ও হ্যারিকেনসহ মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা এবং উঁচু জোয়ারের প্রচণ্ডতা বাড়বে তীব্রভাবে। আর্কটিক ও এন্টার্কটিকার বরফ দ্রুত কমে আসবে ও গ্রীষ্মকালে তা বিলোপ হবে। তাই গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিরাপদ মাত্রা ৩৫০ পিপিএমে নামিয়ে আনতে হবে। না হলে পৃথিবীর অপরিমেয় এবং অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত সঙ্কট এখন আমাদেরও ঘিরে ধরেছে। আমাদের উপকূলীয় ১০ জেলা রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ুবিষয়ক এক প্রতিবেদনে জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বদলে গেছে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরন। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তবে বড় ধরনের শঙ্কার কথা হলো এই যে, জলবায়ুর প্রভাবে কয়েক বছর ধরে আমাদের আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তার মধ্যে বজ্রঝড় অন্যতম। প্রতিবছরই শত শত মানুষ বজ্রঝড়ে নিক্ষিপ্ত বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে অবলীলায়। তা ছাড়া আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন ঘটছে। হাওরাঞ্চল ডুবে গিয়ে খাদ্যে ঘাটতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেখানকার কৃষকদের। ২০০৭ সালে সবচেয়ে বড় প্রলয়ঙ্করী সিডর আমাদের দেশের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করে গেছে।  

বৈশ্বিক উষ্ণতার কবল থেকে আমাদের মানব সম্পদ, কৃষি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০০৭ সালে সিডর আক্রমণ করার সময় সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছিল। তার অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। তাই উপকূলীয় অঞ্চলে বনভূমি সৃষ্টির লক্ষ্যে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সামনের ভবিষ্যৎ যেভাবে জলবায়ু আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা গেলে সমস্যা যতই আসুক, আশা করা যায় ততটা আমাদের ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads