• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় খেলা কাবাডি

জাতীয় খেলা কাবাডি

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় খেলা কাবাডি

  • রীমা আক্তার
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

আধুনিকতার ছোঁয়া ও কালের বিবর্তনে মহাকালের পাতা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলা। ঘরে ঘরে ভিডিও গেমের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সব ধরনের খেলাধুলা। শৈশবে যেসব খেলাধুলায় দিন কাটিয়েছেন আজকের বয়োবৃদ্ধরা, তারাও এখন ভুলতে বসেছেন সেসব খেলার নাম।

এদেশের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে ছিল কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, তাস, লুডু, ফুটবল, কাবাডি বা হা-ডু-ডু, লাটিম ইত্যাদি। এই খেলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে ফুটবল খেলার কিছুটা প্রচলন থাকলেও অন্য সব খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। অতীতে গ্রামবাংলায় যেসব খেলার সবচেয়ে বেশি প্রচলন ছিল তা হচ্ছে হা-ডু-ডু। প্রতিটি দেশের একটি জাতীয় খেলা থাকে। ইংরেজদের জাতীয় খেলা ক্রিকেট, আমেরিকানদের জাতীয় খেলা বেস বল। আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু বা কাবাডি। কিন্তু কালক্রমে এই খেলার কদর হারিয়ে যেতে বসেছে। কিছুদিন আগেও আন্তঃস্কুল বা থানা পর্যায়ে কাবাডি প্রতিযোগিতার আয়োজন চোখে পড়ত। বর্তমানে সেটাও চোখে পড়ে না। অনেকে হা-ডু-ডু খেলার নিয়ম পর্যন্ত জানে না। একসময় একদমে উচ্চারিত শব্দে হা-ডু-ডু খেলার চল গ্রামবাংলায় খুব বেশিমাত্রায় হতো। উৎসব করে আয়োজন করা হতো খেলার। আন্তর্জাতিকভাবেও পেয়েছে স্বীকৃতি এ খেলা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই হা-ডু-ডু। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে হা-ডু-ডু পাঠ্যপুস্তকে শেখা কেবল একটি নাম। এ যুগের ছেলেমেয়েরা তাদের দেশীয় সংস্কৃতির চাইতে বিদেশি বিষয় নিয়েই মাতামাতি করে বেশি। তার শিকার হয়েছে এই খেলাও।

১৯৭২ সালে এ খেলার নামকরণ হয় কাবাডি। সে বছরই কাবাডি জাতীয় খেলার মর্যাদা পায়। তবে জাতীয় খেলার মর্যাদা পেলেও এই খেলা তখন কেবল গ্রামবাংলাতেই হতো। ১৯৭৮ সালে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন গঠন করা হয়। তবে ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কলকাতায় এশিয়ান কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ভারত চ্যাম্পিয়ন এবং বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয় কাবাডি। এই প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রৌপ্যপদক গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

কাবাডি খেলায় দুটি দল অংশ নিতে পারে। প্রতি দলে ১২ জন করে। তবে মাঠে ৭ জনের বেশি নামতে পারে না। বাকি ৫ জন অতিরিক্ত থাকে। খেলা চলার সময় ৩ জন খেলোয়াড় পরিবর্তন হতে পারে। এছাড়া খেলার সময় বিরতিসহ পুরুষদের জন্য ২৫ মিনিট আর মেয়েদের জন্য ২০ মিনিট। সর্বত্র একই নিয়ম প্রযোজ্য না হলেও খেলা অনুষ্ঠিত হতো। স্থানীয়ভাবেও তৈরি হতো কিছু নিয়ম। সাধারণত হা-ডু-ডু খেলায় অংশগ্রহণকারীরা যে জায়গায় খেলা হবে, তার আকার বিবেচনায় নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে চারদিকে দাগ দিয়ে খেলার মাঠের সীমানা ঠিক করে নেন। তবে পরিমাপের দিক থেকে মাঠ যত বড়-ছোটই হোক না কেন, এর আকৃতি হয় আয়তাকার। মাঝখানে দাগ দিয়ে মাঠকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতি ভাগে একেকটি দল অবস্থান নেয়। কাবাডি মাঠের আকার হয় দৈর্ঘ্যে ১২ দশমিক ৫০ মিটার, প্রস্থে ১০ মিটার। এ খেলার নিয়ম অনুসারে, একপক্ষের একজন খেলোয়াড় অপরপক্ষের কোর্টে হানা দেয়। এ সময় সে হা-ডু-ডু বা কাবাডি কাবাডি শব্দ করতে করতে অন্যপক্ষের যে কোনো একজন খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ওই পক্ষের চেষ্টা থাকে সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। যদি ওই খেলোয়াড় দম ধরে রেখে নিজ কোর্টে ফিরে আসতে পারে, তাহলে তার দল পয়েন্ট পায়। আর যদি আটকে থাকা সময়ের মধ্যে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে যায়, তাহলে বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়।

কীভাবে খেলা হিসেবে হা-ডু-ডু বা কাবাডির প্রচলন হয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না। নৃবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মতামত দেননি। তবে ধারণা করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগে এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের আস্তানায় হানা দিয়ে ধনসম্পদ, গবাদিপশু, এমনকি নারী ও শিশু লুট করে আনতো। শত্রুর আস্তানায় হানা দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসার কৌশলের চর্চা ও নিজেদের ফিট রাখার তাগিদ থেকে এমন খেলার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ওই যুগের মানুষ। ব্যক্তি ও দলগতভাবে শত্রুপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে পাল্টা আক্রমণের কৌশল চর্চা করতে গিয়েই সম্ভবত এ খেলার উদ্ভব। এ খেলায় সফলতার শর্ত হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক ক্ষিপ্রতা, পেশির ক্ষিপ্রতা, ফুসফুসের শক্তি ও সহনশীলতা, দ্রুত চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং তা প্রয়োগের সামর্থ্য। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের কৌশল ও মনোভাব অনুধাবনের যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ।

হা-ডু-ডু বা কাবাডি শুধু বাংলাদেশেরই জাতীয় খেলা নয়, প্রতিবেশী ভারতের ছয়টি রাজ্যের জাতীয় খেলা এটি। রাজ্যগুলো হচ্ছে— তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার ও পাঞ্জাব। অবশ্য বিভিন্ন প্রদেশে খেলাটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। এক সময় গ্রামাঞ্চলে হা-ডু- ডু খেলার খুব বেশি প্রচলন ছিল। সময়ের আবর্তনে মানুষের ব্যস্ততা এবং আধুনিকায়ন খেলাটিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কষ্টসাধ্য শারীরিক এ খেলাটি যুব সম্প্রদায়কে আর টানে না।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads