• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শান্তির পথে কে এই বাঁশিওয়ালা

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই বাঁশিওয়ালা এমন এক বিশ্বনেতা, যিনি খুবই অজনপ্রিয়

আর্ট : রাকিব

মতামত

শান্তির পথে কে এই বাঁশিওয়ালা

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০১৮

কোরীয় উপদ্বীপের পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। সত্তর বছরের ভ্রাতৃঘাতী দুশমনির উত্তাপ অনেকটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন উত্তরের রাজধানী পিয়ংইয়ং ঘুরে এসে এক আবেগঘন বক্তৃতায় বলেন, সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন দুই কোরিয়া আবার এক হয়ে যাবে। গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরের সান্তোসা দ্বীপের কাপেলা হোটেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর পরিস্থিতির যে বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা চলে ক্রুদ্ধ নাগিনীর, যে ছোবল মারার জন্যে ফণা তুলে ফুঁসছিল, কিন্তু হঠাৎ কি এক জাদুর বাঁশি শুনে ফণা নামিয়ে ফেলল। বাঁশিটি কে বাজালো? আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই বাঁশিওয়ালা এমন এক বিশ্বনেতা, যিনি খুবই অজনপ্রিয়। বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে এই নেতাকে অনেকে ক্লাউন বিবেচনা করতে পছন্দ করেন। আমরা বলছি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট পদপার্থী হলেন, তখনই সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তার উদ্ভট ও উগ্র আমেরিকানিজমের স্লোগানে নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদেরও অনেকে বিব্রতবোধ করেছিলেন। ডেমোক্র্যাটরা তো চিন্তাই করতে পারেননি যে, এরকম পাগলাটে এক বুড়ো হিলারি ক্লিনটনের মতো সফিসটিকেটেড প্রার্থীকে কুপোকাত করে দেবেন। ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, হিলারিই জিতবেন। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেলো টেক্কা মেরে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ভোটের সময় অনেকেই চমক সৃষ্টি করে সস্তা পপুলারিটি গেইন করার জন্য উল্টাসিধা কথাবার্তা প্রচুর বলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তারা বদলে যান। চেয়ার তাদের বদলে দেয়। এরকম দৃষ্টান্ত দেশ-বিদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনেক আছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ধাতের মানুষও নন, তিনি যেন কিছুতেই বদলাবার নন। তিনি কথাবার্তায় আগের মতোই রয়ে গেছেন। আর কাজেও, ইলেকশনের আগে আমেরিকানিজমের বাহানায় যা যা তিনি বলেছিলেন, তা করে দেখাচ্ছেন। নিন্দামন্দের ধার তিনি কমই ধারেন। অভিবাসন প্রশ্নে কড়াকড়ি করবেন, বলেছিলেন এবং করছেন। এরই মধ্যে আবার ডেকে এনেছেন বাণিজ্যযুদ্ধ। ইরানের সঙ্গে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল প্রায়। ছয়জাতি চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রশ্নে উত্তেজনা ও অবিশ্বাসের অবসান হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি। ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। এমন সময় ছয়জাতি চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ট্রাম্প পাকা ধানে মই দিয়ে দিলেন। পুরনো মিত্রদেরও তিনি খুঁচিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। ইউরোপীয় মিত্ররা বিরক্ত, শান্ত সুশীল জাপানকেও টেনে এনেছেন বাণিজ্যযুদ্ধে। প্রতিবেশী কানাডার সঙ্গেও অর্থনৈতিক খটোমটো লাগিয়ে বসে আছেন। কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিল অনেকদূর পর্যন্ত। সেও এখন ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। তবে অশান্তির পরীক্ষিত দূত ইসরাইলের সঙ্গে পুরনো বন্ধুতার সম্পর্ককে আরো গভীর ও নিবিড় করতে তিনি মোটেও ভুল করছেন না। মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করে তিনি প্রমাণ করেছেন জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। জেরুজালেম ইসরাইলের নয়। এই নগরী মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি— এই তিন ধর্মজাতিরই পবিত্র ভূমি। এখানে রয়েছে মুসলমানের প্রথম কিবলা মসজিদুল আল আকসা। ইসরাইল এই পবিত্র নগরীতে দখলদারিত্ব কায়েম করে রাজধানী স্থাপন করেছে। বিশ্বের কেউই ইসরাইলের এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। আমেরিকাও নয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই জেরুজালেমে অ্যাম্বেসি স্থানান্তর করে দেখিয়ে দিলেন তিনি কারো পরোয়া করেন না। অন্যদিকে নিন্দুকেরাও তার পিছু ছাড়ছে না। তার পুরনো বান্ধবীদের অনেকেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে রগরগে আলোচনার জন্ম দিয়ে চলেছেন। আমেরিকার এহেন অনন্দিত প্রেসিডেন্ট বিশ্বের কোনো প্রান্তে শান্তির পায়রা উড়াতে পারেন, এমনটি চিন্তা করা কঠিন। কিন্তু ভাবতে কঠিন হলেও বাস্তবে সেটাও করে দেখাচ্ছেন তিনি! কোরিয়া উপদ্বীপের আকাশে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে। শান্তির পারাবত উড়ল বলে!

সিঙ্গাপুর বৈঠকের পর উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তত একটি প্ল্যান্ট বন্ধ করেছে। আমেরিকা যদি কথার বরখেলাপ না করে, তাহলে উত্তর কোরিয়াও আর বেঁকে বসবে না। তবে কথা না রাখলে, সহযোগিতার হাত প্রসারিত না করলে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে পিয়ংইয়ং সরে আসবে না- সে ঘোষণাও অবশ্য দিয়ে রেখেছেন কিম জং উন।

কিম ইল সুঙের পৌত্র উত্তর কোরিয়ার আজীবন সুপ্রিম লিডার কিম জং উন মুখে যত গরম ও টাফ মনোভাবই দেখান না কেন, তলে তলে গলা মোমের মতো হয়ে গেছেন বলেই মনে হয়। গত বছর উত্তর কোরিয়া এক সরকারি বিবৃতিতে ট্রাম্পকে মানসিক বিকারগ্রস্ত আমেরিকান বুড়ো বলে উপহাস করেছিল। সেই উত্তরের নেতা সিঙ্গাপুর বৈঠকের পর ট্রাম্পে বিমোহিত। তিনি আমেরিকার আরো বন্ধুতার জন্য অধীর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি আবারো বৈঠক করতে চান। আর এই চাওয়ার কথা জানিয়ে ট্রাম্পকে চিঠি লিখেছেন ফুলেল ভাষায়। ভারি সুন্দর চিঠি। সে কথা ট্রাম্পই জানিয়েছেন সমর্থকদের সভায়। এ কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, কিম জং উনের প্রেমে পড়ে গেছেন। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রত্যক্ষ ফল দেখা যাচ্ছে সত্তর বছরের বৈরিতা ভুলে দুই কোরিয়া পরস্পর কথা বলছে পরম আত্মীয়ের মতো। দুই কোরিয়ার মধ্যে আত্মীয়তা তো ছিলই। এক দেশ, এক ভাষা, এক জাতিসংস্কৃতিরই উত্তরাাধিকারী তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ১৯৪৮ সালে সমাধি রচিত হয়েছিল সেই বন্ধনের। সমাধির ভেতর থেকে আজ আবার জেগে উঠতে চাইছে সাত ভাই নয়, দুই ভাই চম্পা দুই কোরিয়া। এরই মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণে সফর বিনিময় হয়েছে কমপক্ষে তিনবার। উত্তর ও দক্ষিণের মানুষের আজকের স্লোগান- তারা আবারো চান এক দেশ এক কোরিয়া।

দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সংকল্প ঘোষিত হয়েছিল আঠারো বছর আগে। ২০০০ সালের ১৫ জুন উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরা দীর্ঘ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, অদূর ভবিষ্যতে দেশ দুটি আবারো এক পতাকার নিচে চলে আসবে। সেই লক্ষ্যে পিয়ংইয়ং ও সিউল যুগপৎ অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সদিচ্ছা মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৭ সালে উত্তরের পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। রিইউনিফিকেশনের সংকল্প চলে যায় বরফঘরে। শীতল সম্পর্কের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এই ২০১৮ সালে এসে আবার বরফ গলতে শুরু করে। শীতকালীন অলিম্পিককে কেন্দ্র করে একজাতির দুই দেশের মধ্যে সঞ্চারিত হয় সম্প্রীতির নয়া বাতাবরণ। মাস তিনেকের ব্যবধানে সেটা পুষ্পিত হয়ে উঠেছে আরো অনেকখানি। এ বছরের মার্চ কিংবা এপ্রিলে দুই কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতার ঐতিহাসিক মৈত্রীবৈঠকে উভয় পক্ষ সম্মতি জ্ঞাপন করেন সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম পানজুমের যে বাড়িতে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছে পিস হাউজ। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দুই নেতার উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তিই তখন বলে দিয়েছিল যে, তারা এসে দাঁড়িয়েছেন এক নতুন ইতিহাসের সূচনামুখে।

শীতলযুদ্ধের এক অসহায় শিকার কোরিয়ান উপদ্বীপবাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর তৎকালীন দুই পরাশক্তি— আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাগাগাভাগি করে নিল উপদ্বীপটিকে। সোভিয়েত সমর্থিত কিম ইল সুং জুচে অর্থাৎ স্বনির্ভর বিপ্লবের আড়ালে উত্তরে কায়েম করলেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। আর দক্ষিণে গণতন্ত্রের চাদরে আমেরিকানিজম। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভাষা-সংস্কৃতি ও ধর্ম-দর্শনের হাজার বছরের বন্ধন দুই কোরিয়ার কেউই উপেক্ষা করতে পারে না। সেটাই প্রমাণিত হয় দুই নেতার ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

এখন আরো অনেকটা পথ এগিয়েছে দুই কোরিয়া পুনর্মিলনের দিকে। ১৯৫০ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, ’৫৩-তে এসে তার বিরতি ঘটলেও অবসান হয়নি। সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। মাসখানেক আগে সেই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। সীমান্তে পোঁতা হয়েছিল লাখ লাখ ল্যান্ড মাইন। সেগুলোও এখন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি-পথে এই অগ্রযাত্রার অনুঘটক কে? তিনি কি ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি অন্য কেউ কিংবা অন্য কিছু? তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেন, ট্রাম্প আসলে এই যাত্রার তেমন কেউ নন। কথায় বলে, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। আসলে দুই কোরিয়াকে সময়ই নিয়ে এসেছে মিলনের মোহনায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিভাবকত্বে কিম ইল সুং জুচে অর্থাৎ স্বনির্ভরতার স্লোগান দিয়ে যে ডাইনেস্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অস্তিত্বের প্রকাণ্ড সঙ্কট। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরই শুরু হয় এই সঙ্কট। নব্বইয়ের দশকজুড়ে উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলা করতে হয়েছে ভয়াবহ মন্বন্তর। চার লক্ষাধিক মানুষ মরেছে না খেয়ে। সেদিন টনকে টন চাল সাহায্য দিয়ে বৈরী ভাই দক্ষিণ কোরিয়া বিপন্ন উত্তরের পাশে দাঁড়িয়েছে। চীনও সাহায্য করেছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ানদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচানোর চাইতে দেশটিকে আমেরিকার শত্রু বানিয়ে রাখা চীনের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার অস্ত্র ব্যবসা তো আছেই। সে জন্য কিম ডাইনেস্টি মানুষকে খাদ্য ও পুষ্টিবঞ্চিত রেখে রণসজ্জায় ব্যয় করেছে দু’হাতে। পারমাণবিক প্ল্যান্ট বসিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। কিন্তু এখন সে সামর্থ্যও ফুরিয়ে এসেছে। চীনও ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। উত্তরের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। ফণা না নামিয়ে আজ আর গত্যন্তর নেই। এটিই বাস্তবতা।

সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন বার্লিন দেয়ালের মতো উধাও হয়ে যাবে বিভক্ত দুই কোরিয়ার বিভেদের সীমান্ত।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

saleheenfa@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads