• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
কৃষিতে নারীরা বৈষম্যের শিকার

নারীরা কৃষিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার

সংগৃহীত ছবি

মতামত

কৃষিতে নারীরা বৈষম্যের শিকার

  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০১৮

তিমির চক্রবর্তী

নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার চরনগরদী গ্রামের গৃহিণী পারভীন বেগম মাশরুম চাষে সাফল্য অর্জন করেছেন। তার স্বামী আমীর হোসেনও কৃষিকাজ করেন। স্বামীর পাশাপাশি পারভীন বাড়ির আশপাশে শাক-সবজি চাষ করেন।

স্থানীয় একটি এনজিওর অনুপ্রেরণায় তিনি মাশরুম চাষে উৎসাহিত হন। বিষয়টি স্বামীকে জানালে স্বামীও তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেন। তিনি মাশরুমের বীজ সংগ্রহ করে তার ছোট একটি পরিত্যক্ত টিনের ঘরে চাষাবাদ শুরু করেন।

পারভীন জানান, তিনি মাশরুম চাষে সফলতা অর্জন করেছেন এবং ঘরে বসে আয় করার একটি কৌশল শিখেছেন। তার সফলতা দেখে গ্রামের অনেকেই এখন মাশরুম চাষ শুরু করেছেন।

শুধু তিনি নন, কৃষি খাতে এখন নারীরা এগিয়ে চলেছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান খাত হলো কৃষি। অধিকার কর্মীদের মতে, বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৭০ শতাংশের বেশি। মাঠ পর্যায়ের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কম হলেও পারিবারিক কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ শতভাগ।

দেশের পূর্বাঞ্চলে চা শিল্পের মতো বড় সমৃদ্ধ খাতে এবং জুম চাষেও পাহাড়ি নারী শ্রমিকের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, পোনা সংগ্রহ, কাঁকড়া চাষ, ঘেরে মাছ চাষ থেকে শুরু করে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান সুপ্রতিষ্ঠিত।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই (প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ) কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত বিপুল নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়নও করা হয় না।

নারীরা কৃষিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার। জমি, জলা, কৃষিভিত্তিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সেবার ক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ ও সুবিধা খুবই নগণ্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের আধিপত্য বিদ্যমান।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোকপাত করলে দেখা যায়, জিডিপিতে নারী কৃষকের অবদান স্বীকৃত নয়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে দেশজ উৎপাদনের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।

নীতিনির্ধারকরা জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেও সেখানে নারী কৃষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় উপেক্ষিত। এর ফলে স্বীকৃতি ও সাম্যের প্রশ্নে বিভিন্ন স্তরে নারী কৃষকদের প্রতি বৈষম্য দৃশ্যমান।

গৃহস্থালির সব কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী কৃষক গবাদি পশু পালন, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ, শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদন, শস্য মাড়াই ও মাড়াই পরবর্তী কার্যক্রম, শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে যুক্ত আছে। অথচ রাষ্ট্রীয় নানা উদ্যোগ আয়োজনে এখনো নারী কৃষকদের যথাযথ মূল্যায়ন নেই।

নারী কৃষকদের এই অধিকারহীনতা থেকে রক্ষা করা না গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা যেমন হুমকির মধ্যে পড়বে, অন্যদিকে তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নারী কৃষকদের সমস্যাসমূহ হলো- মজুরি বৈষম্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারের কমিটিতে অবহেলার শিকার, কৃষিজমিতে অধিকারহীনতা, সঠিক সময়ে বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ না পাওয়া, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ও সেগুলোর ওপর প্রশিক্ষণের অভাব, আর্থিক মজুরি ও সহজ শর্তে কৃষিঋণ হতে বঞ্চিত, অর্থের অভাবে কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়া, কৃষির ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব।

বাজার ব্যবস্থা নারীবান্ধব না হওয়া ও পরিবহন সমস্যার কারণে নারীরা পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যায় আক্রান্ত। পাশাপাশি সরকারের কৃষিপণ্য ক্রয়ে নারী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনে অবহেলার শিকার হচ্ছে।

আমাদের ‘জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮’ কৃষিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন অধিকার কর্মীরা। এখানে কৃষকের সংজ্ঞা, ঋণের বিষয়, জমির মালিকানা, কৃষক কার্ড ও অন্যান্য বিষয়ে সন্তোষজনক কিছু বলা হয়নি।

কৃষিনীতিতে নারী কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন অধিকার কর্মীরা।

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে যেমন খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ছে অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কৃষি খাতকে গতিশীল করতে হলে সঠিক বিবেচনার ভিত্তিতে কিষানি নারীদেরও ‘কৃষক কার্ড’ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের কৃষি ও কিষান-কিষানির সার্বিক উন্নতির স্বার্থে সামগ্রিক কৃষি সংস্কার কর্মসূচি জরুরি ভিত্তিতে হাতে নিতে হবে। নারী কৃষিশ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষিশ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরাতন ধ্যানধারণা ও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার দেশের নারীসমাজ। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব।

নারী কৃষককে উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক।

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার নারী কৃষক। তাই নারী কৃষককে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে না রাখলে এই অর্জন ধরে রাখা সম্ভবপর হবে না বলে মনে করেন উন্নয়ন কর্মীরা।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর মৌলিক অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ঘোষিত নারীর প্রতি বিরাজমান সবরকম বৈষম্য বিলোপের দলিল, যা সংক্ষেপে সিডও সনদ নামে পরিচিত।

১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহ, কর্মক্ষেত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।

এরই আলোকে আমাদের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ওই বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে অধিকার কর্মীরা মনে করেন।

লেখক : অনলাইন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads