• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঝুলে আছে ২০ হাজার চাকরিপ্রার্থীর নিয়োগ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৮

দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। অনেক চাকরিপ্রার্থীর অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা এখন ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র ছাপানো, পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ, অনেক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভেন্যু ভাড়া, ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদান-এসব কাজের অর্থ চাকরিপ্রার্থীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একজন শিক্ষিত বেকার অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের বোঝা। পড়াশোনার খরচ চালিয়ে একটি পরিবার যখন ক্লান্ত, তখন একদিকে শিক্ষিত এই সদস্যটি পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় আবার চাকরি খোঁজার জন্য পত্রিকা, অনলাইন ব্যবহার, যোগাযোগ, আবেদনের জন্য ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার, খাম, কাগজ, সনদপত্রাদির ফটোকপি, সত্যায়িতকরণ, স্ট্যাম্পযুক্ত ফিরতি খাম, ছবি ইত্যাদি মিলিয়ে বাড়তি আরো একটি আর্থিক বোঝার চাপ পড়ে পরিবারের ঘাড়ে। বুঝতে কষ্ট হয়, যে প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেবে নিয়োগ পরীক্ষার খরচাদি তাদেরই তো হওয়ার কথা- কেন হয় না! লক্ষ করা যায়, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ড্রাফট চাওয়া হয়। আজকাল একটি পদের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার আবেদনের ঘটনা অতি সাধারণ। তার মানে, এখানেও একটা বাণিজ্য হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে এমন একটি অন্যায় প্রথার প্রচলন সত্যিই দুঃখজনক। সরকারি কিংবা বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই এই বাণিজ্য বন্ধ করা এখনই দরকার। পাবলিক সার্ভিস কমিশন সদাশয় সরকারের নির্দেশনায় এই অযৌক্তিক, অনৈতিক প্রথা বন্ধে পরিপত্র জারি করবে-এই প্রত্যাশা দেশের ৫ কোটি তরুণ-তরুণীর।

এক খবরে জানা গেছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঝুলে আছে ২০ হাজার চাকরিপ্রার্থীর নিয়োগ। পাশাপাশি পজিটিভ গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের পাহাড় জমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৬০ লাখ। আর ১৫ বছরের উপরে পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে বেকার রয়েছে ২৬ লাখ। কাজেই বেকারের দেশে এমন অবহেলা বা দীর্ঘসূত্রতা কোনো অজুহাতেই কাম্য নয়। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশন, রাষ্ট্রদ্রোহ-দলমতসহ রাজনৈতিক মতাদর্শতা যাচাই, আইনি জটিলতা, নীতিমালা ও বিধিতে ত্রুটি, লবিং-তদবির, আর্থিক লেনদেনসহ নানা জটিলতায় এ কালক্ষেপণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। তরুণ কর্মজীবীদের জন্য দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগ পদ্ধতি সমাপন করা দরকার। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবন শেষ করে যত তাড়াতাড়ি কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, ততই মঙ্গল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন ধীরগতি যে কারণেই হোক, গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এমনটাই প্রত্যাশা।

পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার দুটি স্তর অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা যায়। সেখানে যদি পাঁচ বছর লাগে নিয়োগ পেতে, তাহলে একজন চাকরিপ্রার্থীর বয়স কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে কথা কেউ কি ভাবেন? এমনিতেই বাংলাদেশে মাস্টার্স পাস করতে একজন ব্যক্তির বয়স ২৪ থেকে ২৭ বছর পর্যন্ত পার হয়ে যায়। দেশের গড় আয়ু অনুযায়ী একজন মানুষের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবন সংসার শুরু করা উচিত ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। কিন্তু নিয়োগের এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে চাকরি পাওয়া আর নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে বয়স হয়ে যায় ৩৫ থেকে ৪০ বছর। কর্মজীবন শুরু করতে এত সময় পার হয়ে গেলে জীবনের সবকিছু গুছিয়ে নিতে পরবর্তী সময়ে হতাশা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত বেকারবিদ্রোহ হতে বাধ্য। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অপরাধপ্রবণতা এমনকি নেশাগ্রস্ততায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে তরুণ প্রজন্ম। নাগরিকদের কর্মজীবন শুরুর ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে নতুনভাবে ভাবতে হবে। নিয়োগ সংক্রান্ত যাচাইসহ যোগ্যতা মূল্যায়নের সব ক্ষেত্রে শুধু সময়ক্ষেপণ বন্ধ করাই নয়- সময়ের ব্যবধান কমিয়ে আরো দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা উচিত। মনে রাখতে হবে, শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণ-যুবাদের যত দ্রুত সম্ভব কাজে লাগালে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক অগ্রগতি ও নাগরিকজীবনের ঔজ্জ্বল্য বাড়বে। একই সঙ্গে অপরাধপ্রবণতা ও সামাজিক অনাচার বহুলাংশে কমে আসবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর ১০ দশমিক ৪ ভাগ বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞানুযায়ী যারা সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কর্মে নিয়োজিত থাকবেন, তারা আর বেকার নন। বাংলাদেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেন না এমন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। বিষয়টি ভাববার মতো। দেশের স্থায়ী উন্নয়নে তরুণদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই। কারণ তরুণরা কাজের সুযোগ না পেলে দেশে অপরাধপ্রবণতা, জঙ্গিবাদ, মাদকসেবন, অপরাজনীতি, প্রতারণাসহ সামাজিক অপরাধ কোনো অবস্থাতেই কমানো সম্ভব হবে না। তাই সরকারের উচিত শিগগির ‘সবার জন্য উপযোগী কর্মসংস্থানের মহাপরিকল্পনা’ প্রণয়ন করা। আমরা জানি শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতসহ দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অপ্রতুল জনশক্তি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাতিষ্ঠানিক জনশক্তির সামঞ্জস্য আনয়নই সরকারের কাছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। আগামী ৫ বছরে দেশে-বিদেশে, সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে, এমনকি আত্মকর্মসংস্থানমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ১ কোটি তরুণ জনশক্তিকে কর্মস্রোতে প্রবাহিত করার সুযোগ-সম্ভাবনা রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩১১টি শূন্য পদ রয়েছে। এই শূন্য পদ পূরণ করার পাশাপাশি প্রতিটি সরকারি অফিসে নতুন পদ সৃজনের মাধ্যমে এবং বর্তমান জনসংখ্যার অনুপাতে জনশক্তি বৃদ্ধি করে কর্মক্ষেত্র দ্বিগুণ করা যেতে পারে। নিরাপত্তা ও সেবায় পুলিশ বাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি, জেলাভিত্তিক কোটা বৃদ্ধি, অনুরূপভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীতে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে প্রচুর জনবল নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। তদ্রূপ দেশের কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেলওয়ে, কৃষিসেবা, বাজার মনিটরিং, উপজেলা-পৌরসভা প্রশাসনে ও সেবা খাতে বিপুল জনশক্তি নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি সমবায় অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো এবং কর্মসংস্থান ব্যাংকের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা দিয়ে অসংখ্য যুবশক্তিকে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে নিয়োজিত করা গেলে একটি কর্মবিপ্লবের সূচনা হবে। সেই সঙ্গে দেশের অপ্রদর্শিত আয়কে বাধা দিয়ে বিদেশে পাচারের সুযোগ না দিয়ে বরং দেশে শিল্প-প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে ১০ বছর মেয়াদি সুবিধা দিলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে প্রভূত সাফল্য আসতে বাধ্য। আশা করি সরকার এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

লেখক : বিশ্লেষক  ও কলাম লেখক

writetomukul36@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads