• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
সনদপত্র অর্জন বনাম প্রকৃত শিক্ষা

শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পড়ালেখাতে স্বাধীনতা প্রয়োজন

সংগৃহীত ছবি

মতামত

সনদপত্র অর্জন বনাম প্রকৃত শিক্ষা

ভিন্নমত

  • শামীম শিকদার
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৮

সমাজের কথা ভাবে না এমন মানুষ হয়তো খুব কমই আছে। তবে কেউ ভাবে একান্ত ভালো মানসিকতা নিয়ে, আবার কেউ ভাবে খুবই মন্দ মানসিকতা নিয়ে। যারা নিতান্তই ভালো মানসিকতা নিয়ে সমাজের কথা ভেবে সমাজকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে, তারা অনেক সময় মন্দ মানসিকতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে না। একদল মানুষ আছে যারা সাধুতার মুখোশ পরে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লিপ্ত থেকে নিজের একটি সুন্দর অবস্থান তৈরি করতে চায়। তাদের নিজেদের জন্য সুন্দর একটি অবস্থান তৈরি করতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় অনেক মন্দ প্রভাব ফেলে। যা তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুধাবন করতে পারলেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয় না। তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে গড়ে তোলা, পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে নয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে চুরি পেশার সঙ্গে নানানভাবে সম্পৃক্ত। চোর তাকেই বলা যেতে পারে, যে সরাসরি হাতেনাতে ধরা পড়ে। এমনভাবেই সমাজের সবাই ভালো মানুষ, কিন্তু যখন সে চুরিতে ধরা পড়ে তখন সে চোরে পরিণত হয়। যারা নিজের স্বার্থের বাইরে কাজ করে, তারাই হচ্ছে প্রকৃত সমাজসেবক বা মানবসেবক। স্বার্থের বাইরে বলতে একেবারে স্বার্থ থাকবে না, এমনটা নয়। কারণ একেবারে স্বার্থ না থাকলে সেখানে কোনো প্রকার প্রেষণা থাকে না। ফলে ধীরে ধীরে নিজের মধ্য থেকে কাজের আগ্রহ কমে যায়।

শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর, আবার তারাই মানুষ ধ্বংসের কারিগর হিসেবে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পড়ালেখাতে স্বাধীনতা প্রয়োজন। তারা যেখানে খুশি সেখানে পড়বে ও কোচিং করবে- এটাই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু কোনো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যদি তার কাছে পড়ার জন্য বাধ্য করে, তবে সেখানে আর স্বাধীনতা থাকল কোথায়। প্রাইভেট ও কোচিং না করে উপায় থাকলেও ক্লাসে মারধর, মন্দ ব্যবহার, পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম দেওয়া ইত্যাদি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ফলে বাধ্য হয়ে শ্রেণি শিক্ষকের ক্লাসে প্রাইভেট বা কোচিং করতে হয়। শ্রেণি শিক্ষকের কাছে পড়ে সাময়িকভাবে ভালো ফল করলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ অংশই মন্দ ফল করে। এখানে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে স্কুলে বা কলেজে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে শ্রেণি শিক্ষক সাজেশনের নাম করে সব প্রশ্ন ফাঁস করে দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফাইনালে তা হয় না বলে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর চোখের জল ঝরাতে হয়। শিক্ষা যেখানে ব্যবসায় পরিণত হয়, সেখানে প্রকৃত শিক্ষা কোথা থেকে আসবে? নিজের স্বার্থের জন্য যেখানে স্বপ্ন ধ্বংস করা হয় সেখানে স্বপ্ন কীভাবে দেখবে? শুধু কোচিং বাণিজ্য নয়, বই বাণিজ্যও চলছে হরদম। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যে বইয়ের নাম বলে দেবে সে বই কিনতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক বার্তার পেছনে যদি অস্বাভাবিক কিছু কারণ জড়িত থাকে, তবে সেখানে প্রশ্ন তোলারই কথা। যে বইয়ের লেখক ভালো নয় এবং প্রকাশনী শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর নয় সে বই কিনতে শিক্ষক বাধ্য করবে কেন? তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এখানে অবশ্যই তার নিজের স্বার্থ রয়েছে।

যে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? এমন এক সময় ছিল যখন জেলায় দু’একজন জিপিএ-ফাইভ পেত। কিন্তু এখন তার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত, এক গ্রামেই এমন মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেখা খুব সহজেই মেলে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা হচ্ছে তারা জিপিএ অর্থ কী তা-ই জানে না। আমাদের দেশের সরকার মনে করছে শিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। খুব সম্ভবত সরকারের এই ধারণায় কিছুটা হলেও ভুল রয়েছে। কারণ শিক্ষার হার ঠিকই বাড়ছে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত বিবেকের সংখ্যা কমছে। শিক্ষিত হয়ে যদি একজন রিকশাচালকের গায়ে আঘাত করা যায়, তবে শিক্ষিত ব্যক্তি অপেক্ষা রিকশাচালক মনে হয় বেশি শিক্ষিত। কারণ শিক্ষা আমাদের মারামারি শেখার জন্য নয়, শিক্ষা হচ্ছে সাম্যের বোধ অর্জনের। এমন বিবেকহীন শিক্ষা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থীর পিতা-মাতাকে সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো উচিত। সনদপত্র অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে নৈতিকতা ও মানবিকতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বড় বড় ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন না করে প্রকৃত শিক্ষার আলো যার মধ্যে রয়েছে তাকে সর্বত্র মূল্যায়ন করা উচিত। আর এমনভাবে যদি শিক্ষা ও সনদপত্র অর্জনকে আমরা আলাদা না করতে পারি, তবে আমাদের পাশাপাশি ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের দেশ।

লেখক : সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads