• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল

জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে মানবতা বিধ্বংসী রক্তাক্ত একুশে আগস্ট

সংগৃহীত ছবি

মতামত

রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০১৮

সত্য স্বয়ম্ভূ। কোনো কোনো সময় সত্যকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় তবে তা ক্ষণিকের জন্য। সত্য তার আপন গতিতে একসময় মিথ্যার ধূম্রজাল ভেদ করে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়। তাই আবারো সত্য সমুচ্চারিত হলো বিচারের বাণীর মাধ্যমে। সমুন্নত হলো ন্যায়বিচারের পতাকা। চৌদ্দ বছর পর জাতি বিচার পেল মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করা ২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের। মহামান্য আদালত দীর্ঘ শুনানির পর গতকাল বুধবার চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘোষণা করলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায়ে মহামান্য বিচারক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন। একইসঙ্গে তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। 

মানবতার বিরুদ্ধে ২১ আগস্টের পৈশাচিক অপরাধ যারা সংঘটিত করেছে, যারা আসুরিক চক্রান্তের মাস্টারমাইন্ড, তারা আজ পবিত্র বিচারালয়ের রায়ের মধ্য দিয়ে নিক্ষিপ্ত হলো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। বিমোচিত হলো বিচারহীনতার কলঙ্ক। পেছনে পড়ে রইল বিএনপি-জামায়াত সরকারের রচিত প্রহসনের কাহিনী। ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্থক উত্তরাধিকারী দেশনেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে খুলে দিয়েছেন ন্যায়বিচারের বন্ধ দুয়ার। ইতিহাসের মেঘমুক্ত দিগন্তে সত্য আজ সূর্যের মতো দেদীপ্যমান। এই দিনটি দেখার জন্য অনেকগুলো বছর অপেক্ষায় ছিল জাতি, ন্যায়বিচারের আশায় অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গণনায় রত ছিলেন ২১ আগস্টের বর্বরতার শিকার স্বজনহারা এবং আহত রক্তাক্ত নারী-পুরুষ।

স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী জামায়াত এবং তার প্রকাশ্য দোসর বিএনপির দুঃশাসনের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে মানবতা বিধ্বংসী রক্তাক্ত একুশে আগস্ট। জননন্দিত জননেত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেদিন তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া ঘাতকচক্র নিরপরাধ জনসমাবেশের ওপর আর্জেস গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে পৈশাচিক আক্রোশে। ওরা মেতে উঠেছিল নরমেধ যজ্ঞে। সেই দানবীয় হিংস্রতার ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। ব্রিটিশ কর্নেল ডায়ারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল জালিওয়ালানাবাগে। সে ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের কাল। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের খোদ সরকার ও তার জোটের নীলনকশায় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে এমন নারকীয় ম্যাসাকার সংঘটিত হতে পারে, তা ছিল অকল্পনীয়। সেদিন মোহাম্মদ হানিফের মতো বিদগ্ধ ও নিবেদিতপ্রাণ আদর্শবাদী জননেতাসহ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মঞ্চে নেত্রীকে ঘিরে মানববর্ম রচনা করে আল্লাহর অশেষ রহমতে নৃশংস হামলা থেকে সভানেত্রীর জীবন রক্ষা করেন। কিন্তু সেই বর্বর হামলায় নিহত হন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। আইভি রহমান মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে শাহাদাত বরণ করেন। আর্জেস গ্রেনেডের স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে আহত হন তিন শতাধিক নেতাকর্মী। তাদের অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। চৌদ্দটি বছর ধরে তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন যন্ত্রণাকর দুর্বিষহ জীবনের বোঝা। মেয়র হানিফও আহত হয়েছিলেন। তিনি সেই জীবনযন্ত্রণা নিয়েই কয়েক বছর পর ইন্তেকাল করেন। এ সময়ের মধ্যে আরো অনেকেই একই কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। যন্ত্রণাকর জীবনকালে তারা দেখলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রহসন, বিচার দেখে যেতে পারলেন না। কিন্তু তাদের শোকসন্তপ্ত স্বজন-পরিজন এবং যারা কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের যন্ত্রণাকাতর চোখের কোণে আজ চিকচিক করছে আনন্দাশ্রু। প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছেন। স্বাধীনতা ও মানবতার প্রতিপক্ষ সেই খুনিচক্র আইনের হাত থেকে রেহাই পায়নি, মাথার ওপর আজ তাদের ফাঁসির রজ্জু। বিএনপি-জামায়াত জোট উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অনেক চেষ্টা করেছে। যে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই নারকীয় কাণ্ড ঘটানো হয়েছে, যারা আক্রমণের শিকার- তাদেরই দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার মতো অসভ্যতার পরাকাষ্ঠাও প্রদর্শন করেছে খালেদা-নিজামী জোট। জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল, আওয়ামী লীগের মামলা পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এক সদস্যের বশংবদ তদন্ত কমিটি করে এই নজিরবিহীন নৃশংসতার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কল্যাণে সেসব নাটক কোনো কাজে আসেনি।

বছরের পর বছর যারা বিচারের আশায় প্রহর গুনেছেন, যাদের চোখের কোণে চিকচিক করছে আনন্দাশ্রু তারা আজ তো মুক্তকণ্ঠে বলতেই পারেন, প্রিয় নেত্রী আমাদের শেখ হাসিনা, আপনি দীর্ঘজীবী হোন। আপনিই পারেন, আপনিই পেরেছেন। জাতির জনক ও নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। খুনিরা শাস্তি এড়াতে পারেনি। পঁচাত্তর-পরবর্তী জারি করা ইনডেমনিটি, বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করা, দেশে এদের রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে পুনর্বাসিত করা— এসবের কোনো কিছুই খুনিদের রক্ষা করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে একুশ বছর পর পঁচাত্তরের ঘাতকচক্রের তৈরি করা কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়ে শেষও হয়ে গিয়েছিল। প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ঘাতকদের। কিন্তু ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে আদালতে নগ্ন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দিয়েছিল। টানা ছয় বছর বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। কিন্তু দিনের শেষে, বিলম্বে হলেও জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। মানবতার জয় হয়েছে। এখনো কয়েকজন ফেরারি পলাতক। সারা দেশের মানুষ অপেক্ষায় আছেন, যারা পলাতক-লাপাত্তা, তাদেরও ফিরিয়ে আনা হবে, পিতৃহত্যা, শিশুহত্যার শাস্তি তাদের পেতে হবেই হবে। এই অমোঘ সত্য তারা উপেক্ষা করতে পারবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। সেই চেতনাগত ঐক্যের শক্তিই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সাহস জুগিয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাজি বাহিনীর খুনি-জালেমদের বিচারের জন্য ১৯৪৬ সালে গঠিত হয় নুরেমবার্গ আদালত এবং সেই আদালতে ঐতিহাসিক ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যে আন্তর্জাতিক আইন প্রণীত হয়, তারই আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ বাঙালি বিচার পেয়েছে। নিজামী-মুজাহিদসহ একাত্তরের ঘাতক দালালরা শাস্তি পেয়েছে। একুশ বছর একাত্তরের খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। শাসনক্ষমতার অংশীদার বানানো হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে পতাকা দিয়েছিলেন। দেশবিরোধীরা দেশের কর্তৃত্ব হস্তগত করেছিল। জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলঙ্কের জগদ্দল পাথর। সেই পাথর অপসারণ করলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। পঁচাত্তর-পরবর্তী একুশ বছর, তারপর আরো পাঁচ বছর— সব মিলিয়ে ২৬ বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধীচক্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপথে যে অজস্র কাঁটা বিছিয়েছে, জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা সেইসব কাঁটা উৎপাটন করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্বের চেতনা আজ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে পুনর্বার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এটা সেই শক্তি, যা জাতিকে একাত্তরে বিজয় এনে দিয়েছে, এই শক্তিমন্ত্র দিয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা, তার লাল সবুজ পতাকা। এই পতাকা আজ সমুন্নত-সম্মানিত বিশ্বদরবারে। শান্তি ও উন্নয়নের রোল মডেল আজ বাংলাদেশ। জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বনেতা। তবু পথ এখনো মসৃণ নয়। বাধা আছে, কাঁটা আছে, দেশবিরোধী চক্রান্ত আছে। তবু পাড়ি দিতে হবে বন্ধুর এই পথ, যেতে হবে আরো বহুদূর। কিশোর কবি সুকান্তের কবিতার ভাষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা, আপনাকে বলি, ‘রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল/উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এদেশ/আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।’   

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads