রুনা ও সুজন (ছদ্মনাম)। একে অপরকে ভালোবাসে। একজন কলেজপড়ুয়া যুবক; অপরজন স্কুলপড়ুয়া কিশোরী। ছেলেটি প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা ও সমাজসেবী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। অপরদিকে মেয়েটি মেধাবী বিতার্কিক বলে খ্যাতি রয়েছে। বাবা হার্টের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর মা অধ্যাপিকা। মেয়ের পরিবার এ অসম প্রেম মেনে নিতে পারেনি। সম্পর্কের শুরু থেকেই বাধা আসে তথাগত অভিজাত উচ্চবিত্ত গর্বিত পরিবারের পক্ষ থেকে। তীক্ষ নজর রাখে তারা। কিন্তু তাদের রক্তচক্ষু, অত্যাচার আর শাসনের লৌহকঠিন শেকলের বন্ধন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছাকে উসকে দেয়।
অভিভাবকদের কড়া নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমায়। শিক্ষিত অর্থবিত্তশালী অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিবার এ ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যেকোনো মূল্যেই তারা কিশোরী মেয়েকে অসম প্রেমের কবল থেকে উদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে প্রেমিক ছেলে, ছেলের মা-বাবাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় থানা মামলা রেকর্ড করে। পুলিশ ছেলের মা-বাবাসহ অন্যদের গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারণ, প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন দেওয়ার এখতিয়ার সাধারণত নিম্ন আদালতের নেই। ৭ ধারায় নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ন্যূনতম ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন’।
কিন্তু টিনএজার প্রেমিক-প্রেমিকার বেশি দিন পালিয়ে থাকা হলো না। তারা স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে। মেয়ের বাবা মা, তাদের উকিল কিশোরী মেয়েকে দিয়ে ‘জোরপূর্বক তাকে অপহরণ করা হয়েছে’ এ সাক্ষ্য দিতে বলে। কিন্তু কিশোর প্রেমে দায়বদ্ধ মেয়েটি ২২ ধারার জবানবন্দিতে আদালতে উল্টো সাক্ষ্য দিল। তাকে অপহরণ করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় তার প্রেমিক বন্ধুর সঙ্গে গেছে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। জবানবন্দিতে তাদের প্রেমের সম্পর্ক জানার পর তার সঙ্গে মা-বাবার অত্যাচারের কথা মেয়েটি জানায়। মা তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করে, বাবা বেল্ট দিয়ে প্রহার করে, ঘুমের মধ্যে ইনজেকশন দেওয়ার ঘটনাও তুলে ধরে। অভিভাবকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তারা দেড় মাস ঘর সংসারও করে। প্রেমিকের বাবা-মা ও পরিবারের প্রতি তার বাবা যে অভিযোগ এনেছেন তা পুরো মিথ্যা। আদালত তাকে তার মা-বাবার হেফাজতে দিতে চাইলেও সে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে আদালত তাকে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের সেফহোমে পাঠায়। সেই সেফহোম থেকে জেদি এই মেয়েটি গোল্ডেনসহ জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে।
এদিকে, থানা পুলিশ ওই মামলায় প্রেমিককে অপহরণকারী ও তার মা-বাবাসহ চারজনকে সহায়তাকারী অভিযুক্ত করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে। তবে ভিকটিমের জবানবন্দির প্রেক্ষিতে আদালত সুজন ও তার মা-বাবাসহ আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন। সুজন এ সময়ে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালাতে থাকে। সে এবং তার বন্ধুরা মিলে ‘আর্তনাদ’ নামে স্থানীয়ভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে এবং নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে থাকে। সুজন আর্তনাদের বর্তমান কমিটির সভাপতি।
মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলার পর্যায়ে ১৪ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে শিশু আদালতের বিচারক সুজনকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন। অপর চার আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। উল্লেখ্য, ভিকটিম রুনা মাইনর (কম বয়স) হওয়ায় তার জবানবন্দি আদালত আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আদালত তার রায়ে আরো জানান, ভিকটিম রুনা পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সরকারি সেফ হোমে থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজ জিম্মায় যেতে পারবে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ইতোপূর্বেও মেয়েটি প্রেমিকের বাড়িতে চলে এলে সুজনের বাবা নিজে মেয়ের অভিভাবকদের ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মেয়ের বাবা ডাক্তার সাহেব তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দয়ের করেন।
অপরদিকে মেয়ের মায়ের বক্তব্য সুজনের পরিবার মেয়েটির এমনভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে যে, মেয়েটি তার পরিবারের স্ট্যাটাস ভুলে জেদ আর মিথ্যা আবেগে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এক দিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে। তার মেয়ে মেধাবী, নাচে, গানে, বিতর্কে তুখোড়। সুজনের শাস্তি প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, আল্লাহর দোয়ায় সঠিক বিচার হয়েছে।
এদিকে কিশোরী প্রেমিকাও অভিমানে ফিরে যায়নি তার মা-বাবার কাছে। আশ্রয় নিয়েছে সরকারি সেফ হোমে। এভাবেই করুণ পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে দুটি তরুণ প্রাণকে। বিচারকের দেওয়া রায় মাথায় নিয়ে প্রেমিক যুগল চলে গেছে কারাগারে আর সেফ হোমে। প্রেমের বাঁধনকে তারা অটুট রেখেছে। কিশোরী প্রেমিকাকে বাবা মা ও অন্য অভিভাবকদের রক্তচক্ষু, শত অত্যাচার, নানা প্রলোভন একটুও টলাতে পারেনি। চিড় ধরাতে পারেনি তাদের ভালোবাসায়। তাদের কাহিনি যেন হার মানায় যেকোনো সিনেমার চরিত্রকে। দুটি নিষ্পাপ প্রাণের ভালোবাসাকে মূল্যায়ন না করা, অভিভাবকদের অদূরদর্শিতা অন্যদিকে পরামর্শ ও প্রশ্রয়দাতাদের ভুলের কারণে রুনা ও সুজনের ভালোবাসার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে জীবনান্তর।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
Email:seraj.pramanik¦gmail.com
