• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
চলনবিলের মানুষের জীবন-জীবিকা

ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে অনন্ত যৌবনা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

জীবনধারা

চলনবিলের মানুষের জীবন-জীবিকা

  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০১৮

মোহাম্মদ অংকন

বর্ষায় বিল আর গ্রীষ্মে আবাদি জমি, এই নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। এই বিলকে কেন্দ্র করে চাষিরা যেমন স্বপ্ন বপন করে, তেমনি জেলেরা স্বপ্নের জাল বুনন করে। বিলকে কেন্দ্র করে শুধু চাষি ও জেলেরাই স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখে চলনবিলাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ এবং দেশবাসী আশায় থাকে চলনবিলে উৎপাদিত ধান ও স্বাদু পানির নানা প্রজাতির মাছের জন্য। পর্যটন আকর্ষক হিসেবেও চলনবিলের নাম সুবিস্তৃত।

ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে অনন্ত যৌবনা। অঢেল পানির মাঝে মাঝে দেখা মেলে কৃষকের বোনা আমন-আউশ ধান। আর অথৈ পানিতে নৌকা ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। চলনবিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বোয়াল, শোল, পুঁটি, পাবদা, খলসে, শিং, বেলে, চিংড়ি, আইড়, কই, বাইমসহ বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ। জেলেরা শেষ রাতে জাল ও নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বিলে চলে যায়। সকাল অবধি তারা মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। আবার অনেকে বড়শি, খড়া জাল, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, সুতিজাল দিয়েও মাছ শিকার করে। এসব মাছ এলাকার স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করার পর তা দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়। বর্তমানে চলনবিলের মাছ বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে।

বর্ষার পানি শেষ হতেই চলনবিলের কৃষকরা মাঠে নেমে পড়ে। পাকা আমন-আউশ ধান কেটে ঘরে তোলে। তারপর জমি থেকে ধানের আগাছা পরিষ্কার করে ইরি ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করে। সবাই ইরি ধানের বীজতলা তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাস দুয়েক পর চলে আসে ইরি মৌসুম। কৃষকরা চলনবিলের মাঠে ধান লাগাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ জমির আইল বাঁধে, কেউ পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে, আবার কেউ কেউ জমিতে পানি দেয়, মই দেয়। এ সময় শীতকাল। কুয়াশা ভেদ করে দলবেঁধে কৃষকরা ধান রোপণ করতে হেঁটে হেঁটে জমিতে যায়। সূর্য ওঠার আগেই তারা যেন বিঘাকে বিঘা জমিতে ধান রোপণ করে ফেলে।

ইরি মৌসুমে চলনবিলের মানুষের অবসর যাপনের সুযোগ নেই। জমিতে ধানের চারা লাগানোর পর প্রতিনিয়ত জমিতে পানি সেচ দিতে হয়। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা, সার দেওয়া ও পোকামাকড় প্রতিরোধ করে কৃষকরা তাদের ধানকে সতেজ করে রাখে। তখন চলনবিল যেন সবুজে ভরে ওঠে। ধানের জমি থেকে তুলনামূলক উঁচু জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের রবিশস্যের চাষাবাদ করে থাকে। যেমন- গম, ডাল, সরিষা, তিল। অনেকে শীতকালীন সবজি চাষ করে। শীতকালে কাঁচা সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রাম পেরিয়ে সেসব শহরে চলে আসে। চলনবিলের উর্বর মাটিতে ধানের ফলন যেমন ভালো হয়, তেমনি আলু, পটোল, পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতার ফলনও আশানুরূপ হয়। কৃষির বিচিত্রতা থাকার কারণে চলনবিলের মানুষ কৃষিজ পণ্যের অভাবে ভোগে না। চলনবিলের স্বাদু পানির মাছ আর জমির টাটকা সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারির সঙ্গে নতুন চালের ভাত খেলে কৃষকের যেন সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

যখন ইরি ধান ঘরে ওঠে, তখন চলনবিলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় কাটায়। সোনালি ধানের আঁটিতে উঠোন ভরে ওঠে, সেই সঙ্গে কৃষাণ-কৃষাণীর মনটাও সাফল্যে ভরে ওঠে। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কৃষকের শ্রম একটু লাঘবের পথে। শ্রমিকরা ধান মাড়াই করে আর গলা ছেড়ে গান ধরে। সবাই মিলে ধান গুদামজাত ও বাজারজাত করে। সারা বছরের আহারের জন্য ধান সিদ্ধ করতে চাড়িতে ভিজিয়ে রাখে। শেষ রাতে উঠে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। তারপর চাল বানানোর মধ্য দিয়ে কৃষকদের ধানের আবাদ যেন শেষের দিকে চলে আসে।

চলনবিলের মানুষের জীবন-জীবিকা ভারি বৈচিত্র্যময়। যাদের কৃষি জমি আছে, তারা কৃষি কাজ করে। কিন্তু যাদের বসতবাড়ি ছাড়া অন্য জমিজমা নেই তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ নদীতে নৌকা চালায়, কেউ বাজারে দোকানদারি করে, কেউ পরিবহন শ্রমিকসহ নানাবিধ পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার মধ্য দিয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বজায় রেখে চলেছে। সামাজিকতার স্পর্শে সবাই যেন আন্তরিক। এ অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনে তার উৎকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায়। পরিবার সচ্ছল হলে প্রতিবেশী কেউই যেন দাওয়াত থেকে বাদ পড়ে না। ধুমধাম করে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়।

চলনবিলাঞ্চলে উচ্চ ধনী যেমন রয়েছে, তেমনি দরিদ্র পরিবারও রয়েছে। ঘরবাড়ির দিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মেলে। কেউ কেউ ইটের দালান তুলেছে, কেউ কেউ দামি টিনের ঘর তুলেছে। দরিদ্ররা ছনবনের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক সময় তারা জীবন-জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। কিন্তু চলনবিলের মতো অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তারা আবার নাড়ির টানে ফিরে আসে। তবে সবাই ভাগোন্নয়নের চেষ্টা চালায়, অনেক সময় পারিপার্শ্বিক নানা কারণে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হয়। এটাই বাস্তবতা। চলনবিলের মানুষ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন শিক্ষিত হওয়ারও পথে। চলনবিলের অনেক গ্রাম আছে যেখানে শতভাগ লোক শিক্ষিত হয়েও কৃষি কাজ করে। চাকরির পেছনে না ছুটে পৈত্রিক সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা এখন ভাগ্য গড়ার দিকে। চলনবিলাঞ্চল যেমন কৃষিজ, মৎস্য উপযোগী এলাকা, তেমনি এলাকাটি মানব সভ্যের জায়গা। মানুষে মানুষে বন্ধন এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য ভালো দিক। নানা প্রতিকূলতাকে বিসর্জন দিয়ে সভ্য জাতি হিসেবে বছর বছর ধরে চলনবিলবাসী জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads