• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
‘তিনা’দের সেই কথা আর এই কথা

‘রাজনীতিতে চির শত্রু চির বন্ধু নেই’ আর ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’

সংগৃহীত ছবি

মতামত

‘তিনা’দের সেই কথা আর এই কথা

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৮

শিরোনামে ব্যবহূত ‘তিনা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় খুব একটা প্রচলিত নয়। তবে কথা বলার সময় অনেকেই সর্বনাম হিসেবে এ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। ব্যাকরণগত দিক থেকেও শব্দটি অশুদ্ধ মনে হয় না আমার। একবচনের ‘সে’ বহুবচনে তারা বা তাহারা, আবার ‘উনি’র বহুবচন উনারা। সে হিসেবে ‘তিনি’র বহুবচন ‘তিনারা’ হলে দোষ কী? অবশ্য ভাষাবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনারা নিয়ে গবেষণা আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আজ এখানে কয়েকজন তিনার সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব বলে মনস্থির করেছি। সেই তিনাদের অতীত এবং বর্তমান কথাবার্তা সঙ্গত কারণেই এখানে প্রধান উপজীব্য হিসেবে স্থান পাবে।

পত্রিকায় দেখলাম, এলডিপি সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ (অব.) বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে তুলোধুনা করেছেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দলীয় কার্যালয়ে এক সভায় বি. চৌধুরীর তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। কর্নেল অলি এবং ডা. বি. চৌধুরী একদা খুব কাছাকাছি ছিলেন। ২০০৬ সালে তারা দুজন মিলে গঠন করেছিলেন নয়া রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, সংক্ষেপে এলডিপি। অবশ্য বেশিদিন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। দল গঠনের ছয় মাসের মধ্যে আলাদা পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বি. চৌধুরী ফিরে গিয়ে তার বিকল্পধারাকে পুনর্জীবিত করলেন, আর এলডিপি’র খণ্ডাংশ নিয়ে পড়ে থাকলেন কর্নেল অলি। দেশের এই দুই তারকা রাজনীতিবিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনি তাদের মধ্যে রয়েছে অদ্ভূত মিল। দুজনেরই রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। তিনিই এ দুজনকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন এবং বিএনপিতে পদায়ন করেছিলেন। আবার তারা দুজনই বিএনপি ছেড়েছেন বর্তমান নেতৃত্বের ওপর গোস্বা করে। শুধু তা-ই নয়, তারা উভয়েই দলত্যাগ করার পর কীভাবে দলের ক্ষতি করা যায়, সে চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর। বিএনপি ছাড়ার পর বি. চৌধুরী আর সে দলের কাছে যেতে পারেননি। অন্যদিকে কর্নেল অলি ২০-দলীয় জোটের শরিক হয়ে বিএনপির নৈকট্য লাভে সমর্থ হয়েছেন। বাহ্যিকভাবে তারা এখন বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়ার হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টারত। কিন্তু নিকট অতীতে তারা কী করেছেন বা বলেছেন, সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে অবাক হতে হয় বৈকি!

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর বি. চৌধুরী বিএনপি এবং দলটির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একহাত দেখে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তার সে সময়ের বক্তৃতা বিবৃতি যদি ফিরে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, কতটা গোস্বা তিনি হয়েছিলেন বিএনপি নেত্রীর ওপর। বেশিদিনের কথা তো নয়। মাত্র একযুগ আগের ঘটনা। সবারই তা মনে থাকার কথা। বি. চৌধুরী বিকল্পধারা গঠন করেছিলেন ২০০৪ সালে, আর কর্নেল অলির সঙ্গে মিলে এলডিপি গঠন করেছিলেন ২০০৬ সালের শেষদিকে। ওই সময় তারা উভয়েই তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়াকে। সে সময়ের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। সহূদয় পাঠকের জন্য এখানে তার কিয়দংশ তুলে ধরছি।

১০ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে বারিধারায় বিকল্পধারার ইফতার মাহফিলে বি. চৌধুরী বলেছিলেন, ‘একজন অমানুষ দেশ চালাচ্ছেন। সংলাপ ব্যর্থ হলে তিনিই দায়ী থাকবেন। অসাংবিধানিক পন্থায় ইচ্ছামতো রাষ্ট্র চালাচ্ছেন সেই দুষ্টলোক- প্রধানমন্ত্রী।’ ওই অনুষ্ঠানে বি. চৌধুরী তনয় মাহী চৌধুরী তারেক রহমানকে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আর তারেক জিয়া বলা হবে না। এখন থেকে আপনি তারেক খালেদা। একজন চোরের মুখে অন্যের দুর্নাম মানায় না’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১১ অক্টোবর ২০০৬)। ৬ নভেম্বর আরেক অনুষ্ঠানে বি. চৌধুরী বলেন, ‘জিয়ার রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটিয়েছে তারা। একদিকে রাজাকার, অপরদিকে দুর্নীতিবাজ ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি।’ ২৬ নভেম্বর বি. চৌধুরী এক সভায় বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে তালাক দিয়ে এসেছি’ (যায়যায়দিন, ২৭ নভেম্বর ২০০৬)। ২ ডিসেম্বর বি. চৌধুরী এলডিপি’র এক সভায় বললেন, ‘দেশের ঘাড়ে দুই মুসিবত চেপে বসেছে। একটি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, আরেকটি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। প্রথমজন ক্ষমতা ছাড়লেও দ্বিতীয়জন পদ আঁকড়ে আছেন। এই দুই মুসিবত দূর না হলে দেশে শান্তি আসবে না’ (সমকাল, ৩ ডিসেম্বর ২০০৬)। ৭ ডিসেম্বর বি. চৌধুরী বললেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট লুটেপুটে গোটা দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। আর এসবের মূল হোতা খালেদা জিয়া। লুটেরা খালেদা জীবনে আর কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’ (আমাদের সময়, ৮ ডিসেম্বর ২০০৬)। ১৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বি. চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সারা দেশে ধানের শীষ চিটা হয়ে গেছে। কুলা দিয়ে ঝেড়ে চিটা দূর করা হবে’ (ইনকিলাব, ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬)। বেগম জিয়ার প্রতি বেজায় ক্রুদ্ধ বি. চৌধুরী তার শাড়ি-গয়না নিয়েও কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই দলীয় এক সভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা হচ্ছে পাঁচ বছরের ম্যানেজারি। লুটপাট দুর্নীতি করে খাওয়ার জন্য জনগণ ভোট দেয়নি। বিএনপি সেটা করেছে বলে তাদের ম্যানেজারি শেষ। দেশের মানুষ খেতে পাচ্ছে না। আর আমাদের ম্যানেজারকে টিভি খুললেই দেখা যায় দু’লাখ টাকার শাড়ির সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকার ডায়মন্ড পরে বসে আছেন’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৯ জুলাই ২০০৬)।

অন্যদিকে কর্নেল অলি আহমদও (অব.) কম যাননি। ক্রমাগত বাক্যাক্রমণ চালিয়েছিলেন বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। তার সে উক্তি- ‘অনেকে বলে মা ভালো ছেলে খারাপ। আমি বলি দুটোই বদমাশ’- এখনো অনেকের কানে বাজে। ২০০৬ সালের ২০ নভেম্বর নিজ এলাকা চন্দনাইশে এক সংবর্ধনা সভায় অলি ‘বিএনপির কবর দেওয়ার’ প্রত্যয় ঘোষণা করে বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে খালেদা জিয়াকে চট্টগ্রামের মাটিতে নামতে দেওয়া হবে না’ (সমকাল, ২১ নভেম্বর ২০০৬)। ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এক সভায় অলি বলেন, ‘এলডিপিকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা বিএনপি’র নেই। এলডিপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপির কবর রচনা হয়েছে’ (মানবজমিন, ৮ ডিসেম্বর ২০০৬)। ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মহাখালীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘গত ৫ বছরে তারা যে দুর্নীতি করেছে, তা এক হাজার বছরের দুর্নীতির সঙ্গে তুলনা করলেও সমান হবে না। ধনদৌলতের দিক থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে ইমেলদা মার্কোসের সঙ্গে তুলনা করা যায়’ (যুগান্তর, ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬)।

কর্নেল অলি এবং বি. চৌধুরীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব অপ্রকাশ্য কোনো বিষয় নয়। বিএনপিতে থাকতেও তাদের দ্বন্দ্ব বেশ প্রকটই ছিল। তারা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। তবে বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়াকে দেখিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা একত্রে এলডিপি গঠন করেছিলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন একসঙ্গে ঘর করা সম্ভব হয়নি তাদের। পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই দুই রাজনীতিক শেষ পর্যন্ত দলে স্ব-স্ব পরিবারের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে আলাদা পথ বেছে নিয়েছিলেন।

যাক, আমরা বর্তমানে ফিরে আসি। বেগম খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচক এই দুই নেতা এখন বিএনপি’র অনেকটাই কাছাকাছি। কর্নেল অলি ২০-দলীয় জোটের শরিক হিসেবে আগেই বিএনপির ছাতার নিচে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। আর বি. চৌধুরী গত কয়েক বছর ধরে ইফতার মাহফিল, রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বেগম জিয়ার পাশের চেয়ারে উপবেশন করার সুযোগ পেয়েছেন। বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ায় বিএনপিকে শামিল করে দলটির ওপর নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি সুখস্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। কিন্তু পুত্র মাহী চৌধুরীর অতিমাত্রায় খবরদারি এবং তারেক রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক কথাবার্তা সে স্বপ্নকে বোধহয় ফিকে করে দিচ্ছে। গত ২ অক্টোবরের বাংলাদেশের খবরের এক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, নেতৃত্ব নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ঐক্যে কাদেরকে নেওয়া হবে কি হবে না- এ বিষয়ে মাহী চৌধুরীর বাড়াবাড়ি ধরনের কথাবার্তা ইত্যাদি কারণে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়তে পারেন বি. চৌধুরী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, পানি যেভাবে যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে জাতীয় ঐক্য শেষ পর্যন্ত সূর্যের মুখ নাও দেখতে পারে। যদি সেরকম কিছু ঘটে, তাহলে আমরা হয়তো ডা. চৌধুরীর কাছ থেকে আবারো নতুন কিছু অমিয় বাণী শুনতে পাব।

রাজনীতির দুটি আপ্তবাক্য হলো- ‘রাজনীতিতে চির শত্রু চির বন্ধু নেই’ আর ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’। এ দুটি তত্ত্ব কে আবিষ্কার করেছিলেন জানি না। তবে আমাদের দেশের সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের হাওয়া বুঝে পাল তোলার ক্ষেত্রে এটা বেশ মজবুত বর্ম হিসেবেই কাজ করে। নইলে মাত্র বারো বছর আগে যে বেগম খালেদা জিয়া বি. চৌধুরীর দৃষ্টিতে ছিলেন চোর, দুষ্টলোক, দুর্নীতিবাজ, আজ তার পাশে বসে ইফতার গ্রহণ করতে, বক্তৃতা দিতে তার বিবেকে বাধে না! বারো বছরে বেগম জিয়া কোন জাদুমন্ত্রের বলে বি. চৌধুরীর চোখে সাধুতে পরিণত হলেন তা এক বিরাট প্রশ্ন। ঠিক তেমনি বারো বছর আগে নিন্দা সমালোচনার তীরে ঝাঁঝরা করতে চেয়েছিলেন যাকে, সেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মেনে ২০-দলীয় জোটের শরিক হতে একটুও দ্বিধান্বিত হননি কর্নেল অলি আহমদ।

রাজনীতিকরা অবশ্য এসবের কোনো ব্যাখ্যা দেন না। কিন্তু আমজনতার মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। তারা বুঝতে পারে না নেতারা কেন সময়ে সময়ে বোল এবং ভোল পাল্টান। অবশ্য সচেতন যারা, তারা বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর মূলে রয়েছে ক্ষমতা নামের সুস্বাদু মূলা। ওটার জন্যই চোখের পলকে শত্রু হয়ে যায় বন্ধু আর চোর হয়ে যায় সাধু। কারো স্মৃতিশক্তি নিয়ে কটাক্ষ করা উচিত নয়। তারপরও না বলে পারছি না, আমাদের রাজনীতিকদের স্মৃতিশক্তি কি খুবই দুর্বল? তারা কি আজ যা বলেন কাল তা বেমালুম ভুলে যান? না হলে আজ যাকে চোর বলে গালি দেন, কাল তাকে কাঁধে নিয়ে নাচেন কীভাবে?

একটি ছোট্ট গল্প বলে আজকের লেখার ইতি টানব। এক রাজনৈতিক নেতার বালকপুত্র পিতাকে জিজ্ঞেস করল-বাবা, বিশ্বাসঘাতক কাদের বলা হয়? পিতার জবাব- যারা আমাদের দল থেকে অন্য দলে চলে যায়, তারাই বিশ্বাসঘাতক। পুত্রের পাল্টা প্রশ্ন- আর যারা অন্য দল থেকে তোমাদের দলে আসে? পিতার নির্লিপ্ত জবাব- তারা দেশপ্রেমিক।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads