• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
কালো চাল থেকে বীজ উৎপাদন

উদ্ভাবনী কৃষক মনজুর হোসেন কালো চাল থেকে বীজ উদ্ভাবন করে চাষ করেছেন

সংগৃহীত ছবি

মতামত

কালো চাল থেকে বীজ উৎপাদন

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৮

বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হার বেশি। মানুষ বাড়ছে হু হু করে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় মাপের চ্যালেঞ্জ। একমাত্র সেচভিত্তিক উচ্চ ফলনশীল ধান ও গম চাষের বদৌলতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। যদিও এখনো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণায় নানা জাতের ধান ও গমের উদ্ভাবন মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার পথে বড় ধরনের অবদান রেখেই চলছে। গবেষণার সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের গবেষণাকে আরো পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। কারণ প্রতিবছর হাটবাজার, নগরায়ণ, বসতবাড়ি নির্মাণের চাষযোগ্য জমি কমে আসছে। স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৭ বছরে ৭ কোটি জনসংখ্যা ১৬ কোটিতে রূপ নিয়েছে, যা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ জনসংখ্যার তুলনায় চাষযোগ্য কম জমিতে একাধিকবার চাষাবাদ করে মানুষের মুখের আহার জোগান দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমদানি নির্ভরশীলতা বাড়বে। যা আমাদের সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই অনুকূল হবে না।

বিরূপ প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় কখনো কখনো আগাম বন্যা, অতিবর্ষণ কিংবা খরার কারণে ফলন বিপর্যয় ঘটে। এ ধরনের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এ দেশের চাষিরা নিরন্তর চাষাবাদ করেই যাচ্ছে। ফলে অনেক সময়েই ফসল বিনষ্ট হলে চাষিদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আশার কথা, এ দেশে এখন শিক্ষিত চাষির সংখ্যাও বাড়ছে। যারা নিয়মনীতি মেনে আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ করায় খাদ্যভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। এদেশের চাষিদের মেধা-মনন এতই বিকশিত যে, মাঝেমধ্যেই মানুষের জন্য কল্যাণকর উদ্ভাবনও করে ফেলেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেখাপড়া করা উদ্ভাবনী কৃষক মনজুর হোসেন কালো চাল থেকে বীজ উৎপাদন করেছেন। শিক্ষিত এই কৃষকের বাড়ি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার মনাগ্রামে। তিনি নিজ গ্রামের চাষের জমিতে কালো চাল থেকে বীজ উদ্ভাবন করে চাষ করেছেন। নতুন এই জাতের ধানের চাষ দেখতে উৎসুক জনতার আগ্রহের যেন শেষ নেই। চাষি মনজুর হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, কৃষি গবেষক ড. আখতার হামিদ খান ধান উৎপাদনে কুমিল্লার চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। শুধু ধান চাষ নয়, এর বাইরে ফল ও ফুলের চাষে কুমিল্লাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। তার কাজ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। ড. আখতার হামিদ খান পামগাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির ফলমূল চাষ করেছেন। চাষি মনজুর হোসেন জাপানের কালো চাল সংগ্রহ করেন। যার প্রতি কেজির মূল্য এক হাজার টাকা। যেখানে সাধারণত সংরক্ষিত ধান থেকে বীজ উৎপাদন হয়, সেখানে চাল থেকে বীজ উৎপাদন করা যে সহজ কোনো কাজ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অসাধ্য এই কাজটি করে সফল হয়েছেন চাষি মনজুর হোসেন। সে চালের গুণাগুণও অনেক। কালো চালে ঔষধি গুণও রয়েছে। এতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা জিআই অনেক কম। জিআই যত কম হয়, সেই খাবার শরীরের জন্য তত উপকারী। যেমন— গ্লুকোজের জিআই ১০০ ভাগ, চিনির জিআই ৮০ ভাগ, সাদা চালের ভাতের ৭২ ভাগ, গমের আটার রুটিতে ৬৫ ভাগ, যা কালো চালে মাত্র ৪২ ভাগ। ফলে কালো চাল ডায়াবেটিস, স্নায়ুরোগ ও বার্ধক্য প্রতিরোধক। এতে ভিটামিন, ফাইবার ও মিনারেল রয়েছে। ফলে অনেকেই বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যের এই চাল কিনে খান। ভারতের আসাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় কালো চালের উৎপাদন হয়। আমাদের দেশেও কালো চাল নিয়ে গবেষণা চলছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গবেষকদের কালো চাল থেকে বীজ উৎপাদনের তাগিদ দিয়েছেন। আশা করা যায়, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এই ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এ ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে অনেক রোগী এ চালের ভাত খেতে পারবেন। এতে উপকারভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।

এমনিতেই বর্তমানে আমাদের দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আর ভাতই আমাদের মূল খাদ্য। সাদা চালে কার্বোহাইড্রেড বেশি থাকায় অনেক রোগী নিয়মকানুনের বাইরে বেশি পরিমাণ ভাত খাওয়ায় সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে সাদা চালের ভাতে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। আর যদি আমাদের দেশে কালো চালের বীজ থেকে উদ্ভাবিত ধানের চাষাবাদ বৃদ্ধি পায়, তাহলে সহনীয় মূল্যে সাধারণ মানুষ এ ধানের চাল কিনে খেতে পারবেন। এ জন্য চাষি মনজুর হোসেনের এ উদ্ভাবন হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ব্যতিক্রম সফলতা। এ সফলতাকে আরো বিকশিত করতে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যেহেতু একজন চাষির ঘরে গবেষণা উপযোগী পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় উপকরণাদি থাকার কথা নয়, সেহেতু চাষি মনজুর হোসেনের সহযোগিতা নিয়ে আমাদের কৃষি গবেষণাগারে গবেষণা চালালে স্বল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ণ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে। অনেক সময় আমাদের দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কিছু উদ্ভাবন বা আবিষ্কার হলেও সহসা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মেলে না। সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হলেও অঙ্কুরেই তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলে না। অন্তত কালো চাল থেকে বীজ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে চাষি মনজুর হোসেনের যে অবদান, তাকে যেন খাটো করে দেখা না হয়। বরং তার এই গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত কালো চালের চাষাবাদকে উৎসাহিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্বারোপ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ফল প্রকল্পের পরিচালক ও ধান গবেষক বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদি মাসুদও বলেন, কৃষক মনজুর হোসেন যা করেছেন তা ব্যতিক্রম। মনজুর হোসেন বিজ্ঞানীদের কাজ করেছেন মর্মেও মন্তব্য করেন তিনি। কিছু চালের ভ্রূণ নষ্ট না হওয়ায় তিনি তা থেকে বীজ উৎপাদনে সফল হয়েছেন। তার এ সফলতা মানবকল্যাণে গোটা দেশে কালো চাল উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা নিয়ে আসুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সমাজকর্মী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads