• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
জ্ঞান, চিন্তার জগৎ ও কর্ম

আমরা দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে ‘শব্দ’ দেখতে পাই না

সংগৃহীত ছবি

মতামত

জ্ঞান, চিন্তার জগৎ ও কর্ম

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০১৮

দৃষ্টিশক্তি যত তুখোড় ও প্রসারিত আমাদের দেখার শক্তিও তত বেশি। দেখা ও জানা দুটি বিষয় এক নয়। দেখা বস্তু সম্পর্কে যখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এবং উত্তরের সন্ধান করি, তখন কেবল আমরা জানতে পারি। যখন কেবল ‘দেখার’ মধ্যে কাজটা সমাপ্ত হয়, তখন ‘জানা’ হয় না। ‘দেখা’ আবার দুই ধরনের- একটি দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে দেখা, অন্যটি ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা। আমরা দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে ‘শব্দ’ দেখতে পাই না। কিন্তু শব্দ যে আছে এর অস্তিত্ব আমাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বুঝতে পারি, এটা সত্য। এখন ‘জানা’ বিষয়টা হচ্ছে, আমি যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি তার মানে আমি জ্ঞানের জগতে ওই বিষয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছি। প্রভাব এখানে দুই ধরনের হতে পারে, আমি যেন সেটাকে করতলগত বস্তু করতে চাচ্ছি, আর নয়তো জ্ঞান-জগতে আমি তাকে বাঁধতে চাচ্ছি। প্রথমটা সংঘাত বাধায় আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে জ্ঞানের নতুন আরেকটি শাখা সৃষ্টি হয়। কারণ, যখন কোনো বস্তুর ওপর আমি জ্ঞানগত প্রভাব বিস্তার করব তখন আমি ওই বস্তুকেন্দ্রিক নতুন এক অভিজ্ঞতা লাভ করব। যা আমার জ্ঞান জগতে নতুন ভাবনার উদয় করবে। তাহলে উপরের কথাগুলো যদি এক বাক্যে এভাবে বলি, জ্ঞান অর্জন করতে হলে আগে দেখতে হবে, চিন্তার জগতে নতুন জিজ্ঞাসা সৃষ্টি করতে হবে ও তার সমাধান বের করতে হবে, তাহলে শুধু দৃষ্টিই জ্ঞান অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন চিন্তা শক্তির উদ্ভব, জিজ্ঞাসা সৃষ্টি ও সমাধান বের করা।

চিন্তার জগৎ নিয়ে বিশেষ আলোচনার কী প্রয়োজন? এমন একটা সংশয়ী প্রশ্ন এই লেখা নিয়ে পাঠক-মনে উদয় হতে পারে। সারাদিন আমরা যে কাজগুলো করি তার পূর্বে কিছু সময় হলেও সে কাজটা নিয়ে ভাবি। পূর্বাপর ফল বিশ্লেষণ করি। কীভাবে কাজটা সুসম্পন্ন করা যায় তা নিয়েও ভাবি। এই যে ‘ভাবনা’ কথাটা, যদি এটাকে বাদ দিই, তাহলে বস্তু জগতে আমরা কোনো কিছুই করতে পারব না। যেমন— একটা মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ তার ব্যক্তিজীবন স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করতে পারে না। এর কারণ কী? সে ব্যক্তিও কিছু না কিছু ভাবে। কিন্তু তার ভাবনাটা সঠিক নয় বলে তার কাজগুলোও সঠিক নয়। তেমনি আমরা যখন চিন্তা করি বা ভাবি, তখন যদি সঠিক চিন্তা না করি ও কাজটা সম্পন্ন করার যথাযথ উপায় বের না করি, তাহলে আমাদের কাজগুলোও সঠিক হবে না। মানব দেহের ‘ড্রাইভার’ হচ্ছে তার চিন্তার জগৎ।

আমরা ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা ১৮০১ থেকে বঙ্গদেশের রেনেসাঁ নিয়ে যদি প্রশ্ন তুলি যে, এই রেনেসাঁর মূল কথাটা কী? সহজ উত্তর হচ্ছে মানুষের চিন্তার ও চৈতন্যের পরিবর্তন। যা বস্তু জগতে আমরা যে কর্ম করেছি তাতে প্রভাব ফেলেছে ও পূর্বের সময় থেকে ভিন্নতা এনেছে। রেনেসাঁ শব্দটি ইতিবাচক। তাই চিন্তার জগৎ যখন ইতিবাচক মোড় নেয় এবং উন্নত হয়, তখন সমাজের গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন আসে। উন্নততর জীবনদৃষ্টির উন্মেষ ঘটে। অগ্রগতির বা প্রগতির পূর্ব কথা হচ্ছে চিন্তার জগতে ইতিবাচক, উন্নত, সৃজনশীল, জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনা এবং বস্তু জগতে সেগুলোর বাস্তবায়ন। আমরা আধুনিকতা বলে যে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত, এই শব্দটির স্বরূপ কেমন? ‘আধুনিকতা’ একটা শুধু ‘শব্দ’, যার অস্তিত্ব কলম দ্বারা কাগজে লিখলে আমরা পড়তে পারি। কিন্তু বস্তু জগতে এর অস্তিত্ব কেমন? আমরা বলছি যে, ১৮০১ সাল থেকে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ শুরু বা ইউরোপীয় আধুনিকতার কথাই যদি ধরি। প্রাচীন বা অন্ধকার যুগেও সূর্য উঠত, রাত আসত ও সময় পরিমাপেও দিন ২৪ ঘণ্টাই ছিল। তাহলে আমরা যুগ বিভাগ করছি কোন ভিত্তিতে? আসলে সময় পরিমাপ বা সূর্য উদয়-অস্ত আধুনিকতার পরিমাপক নয়। আধুনিকতার পরিমাপক হচ্ছে আমাদের চিন্তা ও কর্ম।

কথাগুলো বলছি বিশেষ কারণে। সম্প্রতি আমাদের যুবা-তরুণদের মধ্যে এক ধরনের উন্নতর জীবনের বাসনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমাজ-দেশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে তাদের মধ্যে ভাবনার উদয় হচ্ছে। এটা আমাদের জাতীয় জীবনে পরম পাওয়া। আগামী দিনের জন্য অবারিত সম্ভাবনা। জ্ঞানের দীনতা, পরিচর্যাহীনতা ও প্রতিকূল পরিবেশ এ সম্ভবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেবে। একজন মানুষ যখন কোনো একটা বিষয়ে জ্ঞানগত দখল অর্জন করতে পারে, তখন সে উক্ত বিষয়ে সমস্যা, উত্তরণ ও সম্ভবনার মর্মমূলে গিয়ে ভাবতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের জাতীয় জীবনে চতুর্মুখী সঙ্কট লেগেই আছে। নিত্যনতুন সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। অনেক সম্ভাবনা পূর্বে ছিল, যা সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে নষ্ট হয়েছে, এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যারা দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত তাদের পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের তাগাদা প্রয়োজনমাফিক হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের সমাজে জ্ঞান বিকাশের পথ প্রশস্ত হচ্ছে না। যখন জ্ঞান বিকাশ হয় না, তখন বুদ্ধি আড়ষ্ট থাকে।

মানুষ চাঁদে যেতে পারবে, মঙ্গল গ্রহকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করা সম্ভব— এমন চিন্তা যখন মানুষের মনে উদয় হয়েছে, যখন ভাবনার জগৎ চাঁদ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, তখন মানুষ চাঁদে কীভাবে যাওয়া যায়, সে বিষয়ে গবেষণা শুরু করে এবং মানুষ চাঁদে যায়। যেকোনো বিষয়ে গবেষণা বা নতুন কিছু সৃষ্টি করার পূর্ব কথা হলো সে বিষয়ে চিন্তা করতে পারা। তারপর তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে। যদি আমাদের তরুণ সমাজের চিন্তার জগৎটাই প্রসারিত না হয়, তাহলে উদ্ভাবন বা নতুন সৃষ্টিও সম্ভব নয়। অথৈ সমুদ্রের ওপারে কী আছে তা দেখার বাসনা যদি না জাগত তাহলে আমেরিকা বা আফ্রিকা আবিষ্কার হতো না। সমুদ্রের পানির নিচে কী আছে তা জানার অদম্য ইচ্ছা যদি না জাগত, তাহলে ‘ব্লু ইকোনমি’ বলে কোনো অর্থনীতি হতো না।

মানুষের চিন্তার জগৎ যখন বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবে না। যে মানুষের কাছে বর্তমানটাই মুখ্য তার চিন্তা ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় না। অতীতের কর্মফল আমাদের বর্তমান, বর্তমানের গর্ভে জন্মে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের চিন্তা যদি বর্তমানের গণ্ডি পেরিয়ে আরো উন্নততর না হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎও উন্নত হবে না। আমাদের ভাবনার জগৎ যত সঙ্কীর্ণ, কর্মও তত সঙ্কীর্ণ। সুতরাং আমাদের জাগরণ উন্মুখ তরুণ সমাজের জ্ঞান যদি প্রসারিত না হয়, তাদের এই জাগরণটা সমকালীন ও আগামী দিনের অগ্রগামী বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তখন এটা হবে একটা মামুলি জাগরণ মাত্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪৭ বছরে আমরা যা অর্জন করেছি এর চাইতে আরো অর্জনের সম্ভাবনা ছিল কি-না তা অনুসন্ধান করা জরুরি। এখন এ পর্যন্ত শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি ইত্যাকার বিষয়ে আমাদের অর্জনের ওপর ভিত্তি করে পরনির্ভরশীলতা দূর করা আবশ্যক। বিশ্বে সাহিত্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের অবদানকে বিশ্লেষণের এখনই সময়। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলে আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক সঙ্কট সমাধান আমরা সহসাই করতে সক্ষম হব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads