• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
কোটা নিয়ে আরো কিছু কথা

প্রজ্ঞাপন জারির পর বিচ্ছিন্ন আন্দোলন শুরু হয়েছে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

কোটা নিয়ে আরো কিছু কথা

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০১৮

কোটা কী, কেন, কোটা কে চান বা চান না, কেন কোটা থাকবে কিংবা কোটা থাকার দরকার কী— এই নিয়ে বেশ কয়েক মাস খুব চলল। আমার এক আত্মীয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, তার সন্তানের চাকরি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, কেন কোটা তুলে দেওয়া হচ্ছে? কোটাবিরোধী আন্দোলন কারা করছে আর সরকারই বা কেন কোটা তুলে দিতে চাচ্ছে— এটা তো হবে না! তিনি খুব উষ্মা প্রকাশ করেন। এ উষ্মা একজন সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তার চোখেমুখে খুব উদ্বেগের ছায়া দেখা যায়। আমি প্রতি-উত্তরে বলি, আপনি যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তখন তো কোটা পাবেন বলে করেননি, ভাতা পাবেন বলে করেননি— তো এই নিয়ে এখন স্বাধীনতার এত বছর পর প্রশ্ন কেন? আমি ঠাট্টা করে আরো বলি, যে সুবিধা পেয়েছেন— সেটাও ফিরিয়ে দিন। তিনি তখন ঠিকঠাক কিছু জবাব না দিয়ে বলেন, আমাদের তো সুবিধা দিতে হবে, তাহলে দেশ স্বাধীন করে কী হলো, রাজাকারদের কথায় নাচলে তো হবে না! তার কথাগুলো খুব একটা বিবেচনাপ্রসূত মনে হয় না। তেমন কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু তালগাছটা তার। আমি বললাম, যে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে উঠতি প্রজন্মের আবেগ যুক্ত, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, সে আবেগও তাদের নেই; কিন্তু বাংলাদেশকে তারা ভালোবাসে। ফলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোক; সাধারণ দরিদ্র, মেধাবীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে সুযোগ পাক; ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো লেজুড়বৃত্তি না হোক; অর্থশক্তির সামর্থ্য নেই যাদের, পেশিশক্তির ব্যাপার নেই যাদের, তারা একটা সুস্থ পথে চাকরি পেয়ে যাক; এটাই তারা চাচ্ছে। কারণ, মেধা ও প্রতিযোগিতা যদি শতভাগ নিশ্চিত করা যায়, তবে তারা সফল হবে, ভালো চাকরি পাবে। যা হোক, আমরা দেখেছি আন্দোলনটা খুব বেশি বস্ফািরিত হচ্ছিল। অনেক শিক্ষার্থীই আন্দোলনে জড়িত হয়। সেখানে অংশগ্রহণ বাড়ে, সাধারণ ছাত্ররা যুক্ত হয়, নানা জায়গায় তা ছড়িয়েও পড়ে। এই নিয়ে রাজনীতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারও যে হয়নি, তাও বলা যাবে না। তখন পার্লামেন্টে এই নিয়ে কথা হয়। প্রধানমন্ত্রীও বেশ উষ্মার সঙ্গে ঘোষণা দেন, কোটা থাকবে না। তিনিও বুঝি দাবিটি তখন অযৌক্তিক বলেই গণ্য করেন এবং এটি যে সুবিবেচনাপ্রসূত নয়, সেটাও তিনি অনুভব করেছেন বলে মনে হয়। কারণ, কোটা থাকবে, যা আছে বা যে প্রক্রিয়ায় চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল— তাতে মেধাবীদের কোনো অবজ্ঞা করার ব্যাপার ছিল না। সেখানেও একটা প্রক্রিয়ায় মোটামুটি নিরপেক্ষভাবেই চলে আসছিল। নইলে তো অনাস্থা দেখা দিত। কারণ, আমরা এখনো দেখি, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী পিএসসির নিয়োগের প্রতি আস্থাশীল এবং সেটাই তাদের ভরসাস্থল। ফলে এই কোটাবিরোধী বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে নানা স্তরে (আরোপিত সমস্যারূপে) যেন প্রধানমন্ত্রীর উষ্মার ওপরেই তখন আটকে ছিল। পরে কেবিনেটে কমিটি হলো, তা নিয়ে সময়ও গড়াল। আর এখন নির্বাচনের আগে এই নিয়ে সরকার কাঙ্ক্ষিত প্রজ্ঞাপনটিও জারি করল। তবে এসবের মধ্যে যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যদি কেউ কোটা চায়, তাহলে এখন কোটা চাই বলে আন্দোলন করতে হবে। সেই আন্দোলন যদি ভালোভাবে করতে পারে তখন ভেবেচিন্তে দেখা হবে।’ এখন প্রজ্ঞাপন জারির পর বিচ্ছিন্ন আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব— এই নিয়ে আইনি লড়াইয়ের জন্যও নাকি প্রস্তুতি চলছে। ঠিক আরো একটি সংবাদ, যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করেছিল, প্রজ্ঞাপন জারির পর তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারা বলছে, ‘সংস্কার করে কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখলে এই নতুন সঙ্কট তৈরি হতো না।’ বস্তুত তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না থাকার কারণ, কোটা একেবারে উঠে যাক- এটা তারা চায়নি। যা হোক, এদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংসদীয় কমিটি এক পারসেন্ট হলেও কোটা রাখার পক্ষে কথা বলছে। এসব যাই হোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারি প্রজ্ঞাপনটির জন্য উল্লসিত এবং এর প্রতি আমার ব্যক্তিগত সমর্থন আছে। আর যারা বলছেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল, বাতিলের নয়’— তাদের বলি, বর্তমান প্রজ্ঞাপনটি সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও নয়। পজেটিভ অর্থে নিলে সব সমস্যার সমাধানও এর মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।

যা হোক, কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের জন্য আন্দোলন এবং সে আন্দোলনটির জনসমর্থন ক্রমশ একপ্রকার বিব্রতকর (সরকার তাই মনে করে) পরিস্থিতির দিকে গড়ায়। সেটি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বুঝি ক্ষোভ ও অপমানও যুক্ত হয়ে পড়ে। আমরা দেখি, এই নিয়ে বিরোধীরা সরকারের বিপক্ষে কিছু করার (আন্দোলন বা হুমকিসুলভ) সুযোগ পেয়ে যায়। এক বিরোধী নেতার টেলিফোন কথোপকথন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে লন্ডন থেকে তারেকের কথোপকথনের অডিও বাইরে চলে আসে। বেশ কিছু গুজবেরও সৃষ্টি হয়। সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সড়ক অবরোধসহ নানা রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্রসংগঠনের মুখোমুখি হয়ে পড়ে সাধারণ ছাত্ররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে হামলাসহ বিভিন্ন হলে যে সন্ত্রস্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা বেশ অবাঞ্ছিত ও প্রতিরোধী পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কোটাবিরোধী আন্দোলন যারা করেছে তারা সরকারের পক্ষে, জয় বাংলার পক্ষে, শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দিয়ে রাজপথে আন্দোলন করলেও সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন এ আন্দোলনকে ঠিক মেনে নেয়নি, সরকারও মেনে নেয়নি (সাংসদদের বক্তব্যে তাই মনে হয়েছে)। কারণ, সরকারের এটি নির্বাচনের বছর। সেখানে এত বড় গণজমায়েত তাদের পছন্দ হয়নি। তাদের মতে, সরকারের ভালো যারা চায় তারা প্রতিপক্ষকে এমন সুযোগ করে দিতে পারে না! সরকারের মন্ত্রীরা নানা পর্যায়ে কথা বললেও আন্দোলনকারীদের তেমন আশ্বস্ত করতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার দমনপীড়নের জোরালো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিলেও সংসদ নেতার উষ্মাসুলভ বা বিরক্তিকর ভাষণের ভেতর দিয়ে এ আন্দোলনের অবসান ঘটে চলে। আর প্রজ্ঞাপন জারির পরও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় সরকারে ওই পূর্বের উষ্মাই প্রকাশ পায়। মন্ত্রী মহোদয়রাও বলেছেন, ‘দাবি ন্যায়সঙ্গত হলে প্রধানমন্ত্রী দেখবেন’। এর ফলে এ বিষয়ক উদ্ভূত কেওয়াজ এক্ষুণি যে মিটে যাচ্ছে— হয়তো তা বলা যাচ্ছে না। তবে এই নিয়ে আর কালক্ষেপণও নয়— বলেই মনে হয়।

এখনকার প্রজ্ঞাপনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির (নবম থেকে তেরো গ্রেড) চাকরিতে বিদ্যামান কোটা পুরোটাই বাতিল (আগে যেটি ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয়েছে অগ্রাধিকার কোটায়, বাকি ৪৫ শতাংশ ছিল মেধায়— যে জন্য আন্দোলন হচ্ছিল)। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কোটা বহাল আছে এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বা প্রতিবন্ধীর জন্য যদি কোটা অপরিহার্য হয়, তবে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে। এসব নিয়ে প্রজ্ঞাপনে কিছু বলা নেই। মনে পড়ে, প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি একসময় (সম্ভবত ১৯৭৩-এর দিকে) সব কোটা বাতিলের পক্ষে মত দেয়। সে অনুযায়ী সরকারের এখনকার সিদ্ধান্ত যে প্রবণতা থেকেই হোক, সেটা সঠিক বলেই মনে করি। এই নিয়ে দ্বিধার কিছু নেই। তবে যারা এখন কোটার পক্ষে আন্দোলন করছে, তাদের সরকারের মোকাবেলা করা উচিত। সেটিই হবে সরকারের সঠিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপিত সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসার কোনো সুযোগ নেই।

আমি সরকারের প্রজ্ঞাপনের পক্ষে অবস্থানের কয়েকটি কারণ বলি- এক. আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য অধিকতর সুযোগের পথ তৈরি করাই ছিল আন্দোলনটির মূল লক্ষ্য, সেটি বাস্তবায়িত হয়েছে; দুই. অনগ্রসর মেধাবী-দরিদ্রদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করার পদক্ষেপ এটি; তিন. কোনো জন্মগত সুযোগ না নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ন্যায়ভিত্তিক ও আইনসঙ্গত নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে কায়েম করারই একটি পরিণত প্রচেষ্টা এ আন্দোলন; চার. স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চ পদস্থ চাকরিগুলো মেধাবী প্রজন্মকুলের পথ প্রশস্ত হোক— যা আগামীতে খুব প্রয়োজন; পাঁচ. রাষ্ট্র ও সমাজে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ বাড়বে। যা হোক, এ রকম পয়েন্ট আরো বাড়ানো যায়, কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততার চেতনাটি একটি বাক্যেও তুলে ধরা যায়। সেটি বড় কথা নয়। আমার মনে হয় এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তারা সাম্যভিত্তিক সমাজ ও আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও বলেন। প্রজ্ঞাপনে তাই সুরক্ষিত আছে। এর বিপক্ষে বলার কোনো কারণ নেই। এই নতুন প্রজন্ম তাই-ই চায়। এ প্রাপ্তিটিও এদেশের জন্য অনেক অমঙ্গলজনক নয়। বরং জনহিতকর। ফলে আন্দোলনটি সরকারের নিকট যে প্রবণতাতেই প্রশ্রয় পাক, যেভাবে সরকারি চাকরির এ প্রজ্ঞাপনটি গৃহীত হয়েছে, তাতে আমি সরকারকে আবার অভিনন্দিত করি। সরকার যা করেছে, তা বহাল থাকুক। ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা ২০৪১ সালের ভিশন-মিশন বাস্তবায়নে এটি একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও অগ্রবর্তী পদক্ষেপ বলেই মনে করি। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, কোনো আন্দোলনই বৃহৎ পরিসর পায় না, যদি তার যৌক্তিক সমর্থন না থাকে। এখন বিরোধী ঐক্য তেমন হাওয়া পাচ্ছে না, কারণটা আমরা জানি। ফলে যে প্রজন্ম কোটা বাতিলের আন্দোলন করেছে, সড়কে নিরাপত্তার আন্দোলন করেছে, সেটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দেখানো পথ। আমি এখানে আগেও বলেছি, সরকারের এ দুটো দাবি নির্বাচনের আগে অগ্রাধিকারভিত্তিক মেনে নেওয়া ও আইনে পরিণত করা সমীচীন। কারণ, দুটোই জনদাবি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট তা উপেক্ষিত ছিল। সরকার দুটোই মেনে নিয়েছে। যদিও সড়ক পরিবহন আইনটির পূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে পর্ব আলাদা। কিন্তু কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি একটি সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত, সন্দেহ নেই। এবং এই নিয়ে এখন বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলেও সরকার তা মোকাবেলা করবে। তবে তা বড় কোনো আন্দোলনের পথ পাবে বলে মনে হয় না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads