• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিস্বার্থপরতারই নামান্তর

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সামাজিক যে রূপ ও প্রভাব সংক্রামিত হচ্ছে, তা অতিশয় ভয়ঙ্কর

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিস্বার্থপরতারই নামান্তর

  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০১৮

মো. মনিরুল ইসলাম

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে। মধ্যযুগ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে নিরঙ্কুশ শক্তিসম্পন্ন রাজা বা সরকারকে রাষ্ট্রের প্রতিভূ বিবেচনা করে রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার প্রভৃতির পক্ষে যুক্তিমূলক তর্কাতর্কিতেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বের বিকাশ। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করাই এই তত্ত্বের লক্ষ্য। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে এবং ফরাসি দেশে অষ্টাদশ শতকে এই তত্ত্বের বিশেষ উত্থান দেখা যায়। ইংল্যান্ডের টমাস হবস তার ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থে, জন লক তার ‘টু ট্রিটিজেস অন সিভিল গভর্নমেন্ট’ গ্রন্থে এবং ফ্রান্সের রুশো তার ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের উদ্ভব, সরকারের ভূমিকা এবং ব্যক্তির অধিকার প্রভৃতি প্রশ্নের ওপর তাদের নিজ নিজ চিন্তা প্রকাশ করেন। তাদের চিন্তায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতা বোধের প্রকাশ। তখন সময়টি ছিল সামন্ততান্ত্রিক পর্যায় থেকে ধনতান্ত্রিক পর্যায়ে সমাজের বিকাশকাল। নতুন উদীয়মান ধনতান্ত্রিক শ্রেণির নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্র এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকারের ঘোষণাই ছিল ইংল্যান্ডের ১৬৪৯ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লবাত্মক ঘটনাসমূহ, আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য। সেই সময় থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বেরও বিকাশ ঘটেছে। হবস, লক এবং রুশোর পরে হার্বাট স্পেন্সারের মধ্যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে অবাধ প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ চরম মাত্রা লাভ করে। রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে নিজ নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তার অন্তর্নিহিত সামাজিক সমস্যার ক্রমবৃদ্ধি চিন্তাবিদদের মধ্যে আবার এই বোধের সৃষ্টি করতে থাকে যে, রাষ্ট্র বনাম সরকার তথা ব্যক্তি বোধটি বিদ্যমান সামাজিক সমস্যার চরিত্র অনুধাবনে এবং তার সমাধানে যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্র এবং সরকার যেমন ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি, তেমনি ব্যক্তির জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা ব্যক্তি মঙ্গলের উপায় তাও বলা যায় না।

এসব গেল রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক মশলা মাখানো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আলোচনা। পৃথিবীর জীবনপাঠে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি সব এক রশিতে বাঁধা। সুতরাং একই রশির এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এক রকম বিনা বাধাতেই সমাজ ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সামাজিক যে রূপ ও প্রভাব সংক্রামিত হচ্ছে, তা অতিশয় ভয়ঙ্কর। সামাজিক অনুষঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বটির আলোচনায় অনেকে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ককে একপাশে ফেলে রেখে ব্যক্তি বনাম সমাজ বিতর্ককে সামনে আনেন। সাম্যবাদীদের দৃষ্টিতে সমাজ আগে, ব্যক্তি পরে। পুঁজিতান্ত্রিক মতাদর্শে এ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ বিভিন্ন রকম হলেও মোটের ওপর বলা যায়, ‘সমাজের তুলনায় ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া’ পুঁজিবাদের অন্যতম নীতি। তবে সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী বিতর্ক বাদ দিলে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য যাপিত জীবনেই তা পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি নিয়ে সমাজ। আবার সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির অস্তিত্ব। সমাজের বাইরে ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্ভব নয় বলেই একদিন সমাজের সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সম্পর্কের বিষয়টি অনিবার্য। সমাজ বলতে মানুষের তৈরি একটি সংগঠনকে বোঝায়। এ সংগঠন যুগ হতে যুগে পরিবর্তিত হয়। সমাজের একক ব্যক্তি বটে, কিন্তু ব্যক্তিমাত্রই সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করে না। বহু ব্যক্তির সম্মিলনে সৃষ্ট সমাজ ক্রমান্বয়ে একটা জটিল স্বাধীন অস্তিত্বময় সত্তা হিসেবে ইতিহাসে বিকাশ লাভ করেছে।

পশ্চিমা আধুনিকতাপ্রসূত সমাজে অবাধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও অনিয়ন্ত্রিত উদারতাবাদ সমর্থিত যে সামাজিক বন্ধন তৈরি হয় তা স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার সুতায় গাঁথা। সেখানে পরিবার টিকে থাকলেও পরিবারের সম্পর্কগুলো যৌথ একাকিত্বের। একসঙ্গে থেকেও সবাই স্বতন্ত্র, সবাই একা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নামে এই স্বার্থপরতা সমাজের মানবিক সম্পর্কগুলোকে একেবারে ভেঙে ফেলছে। অবাধ মেটারিয়ালিস্ট লাইফ লিড করে বলেই পশ্চিমাদের মধ্যে আত্মীয়তা, পারিবারিক সম্পর্কগুলো নড়বড়ে। এই স্বার্থপরতার কারণে মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব কিংবা বিচ্ছেদ অথবা বিচ্ছিন্নতাও চরম আকার ধারণ করে। পশ্চিমা সমাজে আজকাল ব্যস্ত সন্তানরা ওল্ডহোমে বেঁচে থাকা বাবা-মাকে বিশেষ দিনে ফুলেল শুভেচ্ছা পাঠায় অনলাইন ফুলদোকানিকে দিয়ে! মৃত বাবা-মায়ের শেষকৃত্যও চলে অনলাইনে অর্ডার করে! এ রকম কঠোর পেশাদারিত্বকে তারা সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের বিকাশ হিসেবেই মেনে নিচ্ছে। ভয়ের ব্যাপারটি হলো, ব্যক্তিস্বার্থপরতার এই বিষবাষ্প বাকি দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষিপ্র গতিতে।

সমাজ বা সমাজের অন্তর্গত সব ব্যক্তির সুখ বা পরিতুষ্টি অর্জন মানবিক সম্পর্ক সৃষ্টির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের সুখবাদী তত্ত্ব মানবিক সম্পর্কের পাঠে খুব বেশি সুখকর নয়। উপযোগবাদী আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ঘরানার দার্শনিকরা গাণিতিক সুখবাদের কথা বলেছেন। গুণগত দিক বিবেচনায় না নিয়ে যেকোনো উপায়ে অর্জিত সুখকে (তা যদি পাশের মানুষকে ঠকিয়েও হয়) তারা সমর্থন করেছেন। কিন্তু সামাজিক সম্পর্কের আলোচনায় সুখের গুণগত দিকেই মূলত গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুখের সামাজিক সংবেদনশীলতার অনুভূতি রয়েছে, যেখানে পাশের মানুষকে সুখে রাখার মধ্যেও একটি সুখ রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের যেকোনো উপায়ে অর্জিত ব্যক্তিগত সুখই বরং সামাজিক অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং এই অসুখটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বর্তমান প্রজন্ম ‘মানুষের সঙ্গে না মিশতে পারা’ রোগে ভুগছে। এরা ‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ বোধটি অর্জন করতে আগ্রহী নয়। পুঁজিবাদী ব্যস্ততা ও স্বার্থপরতার চেতনা নতুন প্রজন্মকে এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে।

পুঁজিবাদী ব্যস্ত দুনিয়া সামাজিক যোগাযোগের নামে এমন এক নতুন প্রবণতা চালু করেছে, যেখানে ডিভাইসভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের নামে এক অসামাজিক প্রজন্মের সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের নামে কী ভয়ঙ্করভাবেই না এরা অসামাজিক হয়ে উঠছে!

প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, আছে চমৎকার গুণাবলি। ব্যক্তিস্বার্থ যদি সমাজস্বার্থের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, তাহলে ব্যক্তিস্বার্থে মন্দ কিছু নেই। সমাজ ব্যক্তিজীবনের অবস্থাকে উন্নত এবং ব্যক্তিচরিত্র ও ব্যক্তির গুণাবলিকে বিকশিত করে তুলতে নিবিড় ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক সমাজ ব্যবস্থায় অবাধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নামে ব্যক্তিস্বার্থকে যেভাবে সমাজ পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে সেখানে আতঙ্কিত হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে।

এই নব্য প্রবণতা নিশ্চয়ই মানবিকবোধের সমাজকে জড়বাদী সমাজে রূপান্তরিত করবে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা বিশ্বাস করে স্বাতন্ত্র্য বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিজীবন অথবা স্বার্থপরতার বোধ ব্যক্তির মৌলিক প্রতিভা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বে এই মৌলিকত্বের বিকল্প নেই। অপ্রিয় সত্য হলো, এই বিশ্বাসই মানবিক সম্পর্কগুলোকে হত্যা করছে। যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ খামখেয়ালী, স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতার নামান্তর হয়, তাহলে চলমান সঙ্কটকে আরো গুরুতর করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads