• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রেণিকক্ষের বাইরের পাঠ

শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষা দেওয়ার বা গ্রহণ করার কয়েক ধরনের সুবিধা আছে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শ্রেণিকক্ষের বাইরের পাঠ

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০১৮

ধরুন কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া খারাপ ছিল, ঝড়-বৃষ্টি ছিল কিংবা মেঘলা আকাশ ছিল, গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল। তারপর মেঘ কেটে গিয়ে আবহাওয়া ভালো হলো, প্রকৃতি হাসতে শুরু করল। আপনি ক্লাস শুরু করলেন সেই চার দেয়ালের মধ্যে। বাস্তব চিন্তা করে দেখুন আপনার নিজের কাছে তা কতটা ভালো লাগবে। প্রকৃতিগতভাবে দেখবেন শিক্ষার্থীরা বার বার বাইরে তাকাচ্ছে। প্রকৃতি তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাইরে আসার জন্য। এ সময় আপনি তাদের ক্লাসরুমের ভেতরে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবেন? হ্যাঁ, আটকে রাখতে পারবেন তাদের দেহটা, মন কিন্তু বাইরে চলে যাবেই, কারণ তাদের মনের ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। আর প্রকৃত শিক্ষা ঘটে থাকে তখনই, যখন শরীর ও মনের ইচ্ছে একই বিন্দুতে অবস্থান করে।

শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষা দেওয়ার বা গ্রহণ করার কয়েক ধরনের সুবিধা আছে। এখানে শিক্ষা বাস্তব পরিবেশে ঘটে বলে শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়ের ওপর স্বচ্ছ ধারণা জন্মে, শিক্ষাগ্রহণ হয় বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক। যে বিষয়ের ধারণা শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের ভেতরে তৈরি করতে পারে না, উন্মুক্ত ও বিস্তৃত প্রকৃতির কোলে তা তারা সহজেই বুঝতে পারে। ধরুন, আপনি মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল ইত্যাদি পড়াচ্ছেন হয় ছবি এঁকে বা উদাহরণ দিয়ে। তা না করে আপনি যদি বিদ্যালয়ের পাশে কোনো বাগানে নিয়ে শিক্ষার্থীদের সরাসরি গাছ দেখাতে পারেন, তা হলে সে সহজে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবে এবং ওই শিক্ষার কথা তারা সহজে ভুলবে না। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আপনি তাদের পাখার ক্লিপ কিংবা বাঁধন খুলে দিয়েছেন। তাদের মন উন্মুক্ত হলো এবং উন্মুক্ত মন এমন কিছু সৃষ্টি করবে যা সম্পর্কে আপনি প্রস্তুত ছিলেন না, আপনি আবিষ্কার করতে পারেননি যে, ওই শিক্ষার্থীরা কী কী করতে পারে। এতদিন তারা পরিবেশ পায়নি বলে করতে পারেনি। আপনি যে বিষয়েই পড়ান না কেন, সব বিষয়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটবে।

আমরা সবাই জানি, পর্যবেক্ষণ শিক্ষা গ্রহণ করার একটি চমৎকার পদ্ধতি। ছোট শিশুরা পানি বালু নিয়ে খেললেও তার মধ্য থেকেও তারা অনেক কিছু শেখে আর বয়স্করা প্রকৃতির রহস্য খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দু’দলই বাস্তব অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এসব পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা সহজেই মোটিভেটেড হয় ক্লাসরুমে আসার জন্য। কারণ তারা জানে তাদের শিক্ষা গ্রহণের জায়গা শুধু ক্লাসরুম নয়, উন্মুক্ত পৃথিবী এবং তাদের শিক্ষক সেসব স্থান ও সুযোগ  ব্যবহার করেন তাদের শিক্ষাদান করার জন্য। বাইরে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে স্বভাবগত একটি পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং তারা দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে। তখন তাদের অনেক কিছুই বলে দিতে হয় না, নিজ থেকেই করে। আর এই বিষয়গুলো শত চেষ্টা করেও আপনি ক্লাসরুমে শেখাতে পারবেন না।

আপনি ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে শেখালেন। তাতে আপনার শরীর বিশুদ্ধ ও উন্মুক্ত বাতাস গ্রহণ করার সুযোগ পেল, শিক্ষার্থীদেরও উন্মুক্ত ও বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণের সুযোগ হলো যা শরীর ও মনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষাদান করার আরেকটি লাভজনক দিক হলো বিনা পয়সায় অবারিত শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার। এই উপকরণগুলো আপনাকে কিনতে হচ্ছে না। আর উপকরণ ছাড়া শিক্ষা তো সম্পূর্ণ হয় না। সর্বোপরি বলা যায়, ক্লাসরুমে বাইরের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ায়, চতুর্মুখী হয়; বিস্তৃত ও উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করার ফলে মানসিকতা উদার হয়, যা বদ্ধ ঘরে বসে সম্ভব নয়। প্রকৃতিগতভাবেই তখন তাদের ভেতর নেতৃত্বের গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়গুলো শিক্ষাদানের বা শিক্ষা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত। কিন্তু এখন আমরা কী দেখছি? শিক্ষার্থীরা শুধু একটি ভালো গ্রেড পেলেই সবাই বাহবা দিচ্ছে, সবাই খুশি হচ্ছে, গ্রেডই হচ্ছে সবকিছু বিচারের মানদণ্ড। অথচ এর সঙ্গে বাস্তব জগতের খুব একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আপনি নিশ্চিত নন, শুধু গ্রেডের বদৌলতে একজন শিক্ষার্থী জীবনে অনেক দূর এগোবে। বরং যেসব শিক্ষার্থী বাস্তব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে, বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তারাই জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর কিছু কিছু কাজ খুব প্রশংসনীয়। প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের কিছু প্রজেক্ট ওয়ার্ক করতে হয়। যেমন— অটিস্টিক শিশুদের জন্য সহায়তা প্রদান করার নিমিত্তে তারা ফান্ড সংগ্রহ করে এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অটিস্টিকদের সহায়তা করে।  বিষয়টির ওপর সেমিনারের আয়োজন করে, তাদের জন্য আর্ট এবং ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, অটিস্টিকদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করে। এগুলোর আয়োজন করা একদিকে যেমন সামাজিক দায়িত্বাবলি সম্পর্কে তাদের সচেতন করে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মেশার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। আমাদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। তারা শুধু ক্লাস আর কোচিং নিয়েই ব্যস্ত, তাদের জগৎ যেন এখানেই সীমাবদ্ধ। এ থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads