• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ঋতুচক্রের পরিবর্তন ও বিরূপ প্রকৃতি

বিরূপ প্রকৃতির রোষানলে পড়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ঋতুচক্রের পরিবর্তন ও বিরূপ প্রকৃতি

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০১৮

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত মিলে ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রকৃতির যে নিয়ম চলে আসছে, এখন কিন্তু আর সে অবস্থায় নেই। এ বছর আবার আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকালে বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এখন শরতের শেষ, হেমন্তের শুরু। তবুও চলছে দাবদাহ, বৃষ্টিবাদল, সমুদ্রে নিম্নচাপ এবং উজানের পানির ঢলে বন্যা ও তীব্র নদীভাঙন। বিশেষ করে কয়েক দিনের নদীভাঙনে শরিয়তপুরে মানুষের যে আহাজারি দেখেছি, তা অনেক কষ্টের। একই সময়ে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে চলছিল দাবদাহের তীব্র কষ্ট। প্রকৃতির এ ধরনের খেলা অতীতে কখনই দেখা যায়নি। এর মূলেই রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই এখন উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, খরা, শীত ও আগাম বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রকৃতির এ ধরনের বিরূপ প্রভাবে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অথচ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে নির্বিঘ্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই হাটবাজার, গ্রাম উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, নগরায়ণ, বসতবাড়ি নির্মাণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিবছরই অন্তত এক শতাংশ করে  কমে আসছে। অথচ মানুষ বাড়ছে। এমতাবস্থায় কোনো বছর ধান উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্যশস্য আমদানি করে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হয়। যেমন- গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অসময়ে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানির ঢলে হাওর অঞ্চল খ্যাত জেলাগুলোর আধাপাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এর ওপর আবার গোটা দেশে ‘নেকব্লাস্ট’ রোগে আক্রান্ত হয়ে ধানের ফলন বিপর্যয় ঘটে। ফলে দেশে দেখা দেয় খাদ্য সঙ্কট। বেড়ে যায় চালের দাম। বাধ্য হয়ে সরকারকে শুল্ক প্রত্যাহার করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল, গম আমদানি করে ভোক্তার চাহিদা পূরণ করতে হয়েছিল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও আমাদের খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলা করতে হয়।

অতিসম্প্রতি ‘তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতে জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে এখন দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী। জলবায়ুর এই ঝুঁকিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে মর্মে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকা পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতির প্রভাব মোকাবেলায় কৃষি খাতের বাইরে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কৃষি খাতের বাইরে ১৫ শতাংশ বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনে জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। অথচ আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি যে পরিমাণ সমৃদ্ধ হয়েছে, সে অনুপাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য। কিন্তু কেন? বিনিয়োগ উপযোগী অবকাঠামোগত সমস্যা তো কমবেশি লেগেই আছে। এর ওপর আবার উপার্জিত অর্থ দেশীয়ভাবে বিনিয়োগের বদলে বিদেশে সে অর্থ পাচার করাকেই অনেকেই নিরাপদ ভাবেন। ফলে দেশের অর্থ দেদার বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই নিয়ে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও উদ্বিগ্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খতিয়ে দেখছে, আমদানি কিংবা রফতানির আড়ালে আদৌ কি অর্থ পাচার হচ্ছে? কমবেশি আমরাও উদ্বিগ্ন, কেন বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। আর বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কমবেশি ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারের আমলেই দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে মর্মে নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময়েই পত্রিকায় খবর হয়েছে। যে কোনো মূল্যেই হোক, অর্থ পাচার রোধ করতেই হবে। তা না হলে কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্ব বাড়তেই থাকবে। হতাশার চোরাবালিতে সম্ভাবনাময় কর্মক্ষম হাতগুলো বিপথগামী হবে। যা একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য কোনোভাবেই অনুকূল হবে না।

অতিসম্প্রতি জাতীয় কয়েকটি পত্রিকায় ‘অনেক স্বপ্ন ছিল চাকুরি করব, মায়ের মুখে হাসি ফোটাব’ শিরোনামে মর্মান্তিক এক ঘটনা প্রকাশিত হয়। সৈকত রঞ্জন মণ্ডল, বাবার নাম কৃষ্ণ মণ্ডল, মা রানী মণ্ডল, বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়। তিনি ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি’র ছাত্র ছিলেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর’১৮ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাজা গেটের পূর্ব পাশে একটি দোতলা ভবনের মেস থেকে সৈকতের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সৈকতের ডায়েরির পাতায় লেখা ‘অনেক স্বপ্ন ছিল চাকুরি করার, মায়ের মুখে হাসি ফুটাব। সব এলোমেলো হয়ে গেল। মায়ের শরীরও খুব খারাপ।’ এমনি কিছু কথা লিখে যায় আত্মহত্যার আগে। হয়ত হতাশা থেকেই সৈকত মৃত্যুর পথই বেছে নিয়েছে। কিন্তু এ পথ কোনোভাবেই সঠিক নয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিটি মানুষকে বেঁচে থেকেই রুটি-রুজির চেষ্টা করতে হবে।

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলব, যেহেতু বিরূপ প্রকৃতির রোষানলে পড়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, সেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলোর সহায়তার দিকে চেয়ে না থেকে প্রতিবছর আমাদের জাতীয় বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলার জন্য বরাদ্দ রেখে প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিশেষ করে আমাদের দূষণমুক্ত পরিবেশ, সবুজবেষ্টনী আরো মজবুতকরণ, বন উজাড় রোধ করাসহ প্রাণিবান্ধব পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। তা না হলে নিকট ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের মানুষকে আরো প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের রোষানলে পড়তে হবে।

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads