• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মাহবুব তালুকদারের স্বরূপ

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০১৮

প্রভু! তোমার কাছে প্রার্থনা করতে গিয়ে আসল কথা ভুলে গিয়েছিলাম

তুমি আমাকে এবার বাঁচিয়ে তুললে

আমি তোমার ইচ্ছামতো সৎকর্মে জীবনপাত করব,

এতদিন পরলোকের চিন্তা একদম মাথায় ছিল না

এবার পরলোকের বিপদাপদ থেকে উদ্ধার পেতে

ইহলোকের দিনগুলোকে কাজে লাগাবো।

তুমি আমার রোগমুক্তি দাও প্রভু!

 

এই হলো মাহবুব তালুকদার। তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘মৃত্যুশয্যায় আমি একা’-এর ‘রোগ মুক্তির প্রার্থনা’ কবিতার শেষ পঙক্তিগুলোতে তার আর্তি ফুটে উঠেছে। এ কাব্যগ্রন্থ সমাপ্ত করার আগে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লাইফ সাপোর্টে চলে যান। লাইফ সাপোর্ট থেকে অনেকেই ফিরে আসে না। চলে যান না ফেরার দেশে। মাহবুব তালুকদার মিরাকলি ফিরে এসেছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার লেখালেখিতে হাত লাগান। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও পত্রিকায় কলাম লিখতে থাকেন।

লিখতে থাকেন দেশ, জাতি ও কল্যাণ রাষ্ট্রের পক্ষে। একজন বহুমাত্রিক জাঁদরেল সচিব থাকার সুবাদে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল পরিপূর্ণ, তার প্রকাশ লেখাগুলো সমৃদ্ধ করেছে। কবিতায় তিনি বাংলা সাহিত্যে অনন্য প্রতিভা। আমি তার একজন গুণমুগ্ধ ভক্তও বটে। তার ‘মৃত্যুশয্যায় আমি একা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘শৈশবে ফিরে যাওয়া’ কবিতার শেষ চার চরণ উল্লেখ করে অন্যদিকে যাব—

জীবনের ঘটনাগুলো সামনে রেখে সময় পার করতে হবে-

কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল, তা তো জানাই আছে

এবার পা ফেলতে হবে ভেবেচিন্তে, যাতে পরিতাপ করতে না হয়।

(হায় ঈশ্বর! নতুন করে ভুল করলে তা ঠেকাব কী করে?)

মাহবুব তালুকদারের বর্তমান স্বরূপ উন্মোচনের জন্য দুটি কবিতার উদ্ধৃতি মনে হয় যথেষ্ট। মানুষ মাহবুব তালুকদার, কবি মাহবুব তালুকদার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এক অভিন্ন মানুষ হিসেবে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের দিকে সবার নজর। নানা বিতর্ক। মাহবুব তালুকদার অন্য কমিশনারদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করায় তিনি আলোচনায় উঠে এসেছেন।

এর আগেও তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সিইসির সভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক থেকে তিনি গুরুতর অভিযোগ তুলে সভা থেকে বেরিয়ে আসেন। কমিশনের ৩৬তম সভায় ১০ মিনিটের মাথায় তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বেরিয়ে আসেন। এবার আসেন বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে। তিনি পরে সাংবাদিকদের সভা বর্জনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারিত্বমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা’ শিরোনামে আমি যা আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, আমাকে নির্বাচন কমিশন সভায় তা উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। অথচ গত ৮ অক্টোবর ইসি সচিবালয়ে থেকে ইউও নোটের মাধ্যমে আমাকে এই সভায় তা উপস্থাপনের জন্য জানানো হয়েছিল। আমাকে আমার প্রস্তাব উপস্থাপনের কথা থাকলেও তা করতে দেওয়া হয়নি। আমার প্রস্তাব উপস্থাপন করতে না দেওয়ায় আমি অপমানিত হয়েছি। আমার মৌলিক অধিকার সংবিধান প্রদত্ত। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এ অধিকার খর্ব করতে পারে না। এভাবেই তিনি তার কৈফিয়ত দিয়েছেন।

মাহবুব তালুকদারের পাঁচ সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসির সংলাপে ২৬টি দল সেনা মোতায়েনের পক্ষে ও তিনটি দল বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর সব নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। ভোটে সেনা মোতায়েন হলেও তারা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে তা গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনী বাদ দেওয়ার পর তাদের কার্যপরিধি কেমন হবে তা নির্ধারিত হওয়া উচিত।  এ ছাড়া দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এ নির্বাচনটি একটি দল বর্জনও করেছে। তবে বর্তমান বিরোধী দল সরকারের পাশাপাশি মন্ত্রিসভায়ও অংশ নিয়েছে। এ অবস্থায় কীভাবে একটি দল সরকারে ও বিরোধী দলে থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কঠিন সমস্যারও সমাধান হতে পারে। ভোটে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি নির্বাচনের পূর্বশর্ত। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারি দল যে সুবিধাদি ভোগ করে বিরোধী দল তা পারে না। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের কমিটি ধরে ধরে মামলা দায়ের ও গায়েবি মামলা দায়েরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণার আগে ইসি সম-আচরণ নিশ্চিতে বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। নির্বাচনকালে সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করতে বলেছে অনেকে। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ইসির নিকট অর্পিত হলে জন-আস্থা বেড়ে যাবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তা সহায়ক হবে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য মনে হলে তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের সঙ্গে তা নিয়ে ইসির সংলাপ করা উচিত।

‘মৃত্যু শয্যায় আমি একা’ কাব্যগ্রন্থ প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হয়— মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনে একা। লাইফ সাপোর্টে তিনি লড়ে মিরাকলি জয়ী হয়ে জীবনে ফিরে এসেছেন। তিনি কি নির্বাচন কমিশনে একা লড়ে-দেশ, জাতি, রাষ্ট্রের কল্যাণে মিরাকলি জয়ী হতে পারবেন!

তিনি সত্তর ঊর্ধ্ব বয়সে কবিতায় তো বলেই ফেলেছেন— 

‘কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল, তা তো জানাই আছে

এবার পা ফেলতে হবে ভেবেচিন্তে, যাতে পরিতাপ করতে না হয়।’

আমার মনে হয় মাহবুব তালুকদারকে পরিতাপ করতে হবে না। তিনি তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন এবং ভুল না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। তিনি হয়তো তার সঠিক পাথেই আছেন।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক, বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads