• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

গ্রাফিতি : প্রতিরোধ আন্দোলনের হাতিয়ার

  • মোহাম্মদ অংকন
  • প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০১৮

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোতে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। অতীতেও গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিরোধ আন্দোলনের নজির পাওয়া গেছে। যেমন- দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন কিংবা সম্প্রতি যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও ছিল গ্রাফিতির জোরালো উপস্থাপনার বহিঃপ্রকাশ। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বিশ্বকাপে পথশিল্পী পাওলো ইতোর আঁকা একটি গ্রাফিতিতে ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে ফুটবলের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছিল। এটি আঁকা হয়েছিল আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিলের অমিতব্যয়ী আচরণের প্রতিবাদ হিসেবে। এ রকম গ্রাফিতি সমাজে সাময়িক আতঙ্কের সৃষ্টি করলেও ফলত ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করে থাকে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও গ্রাফিতি অঙ্কনের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন ও জনমনে ঘটনার সত্যটা বোঝানোর প্রয়াস চলে আসছে। নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’ দেয়াল লিখনটি বেশ নজর কেড়েছিল। পরের দশকে আরেকটি দেয়াল লিখন ‘অপেক্ষায়...নাজির’ দেখা গিয়েছিল। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে এগুলোকে ব্যাখ্যা করতেন। বর্তমান সময়েও এসব গ্রাফিতি অঙ্কনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তবে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গ্রাফিতিগুলো সমসাময়িক দুঃসাহসিকতার বার্তাবহন করে চলেছে বলে অনেকেই তা সমর্থন দিয়ে আসছেন।

মাত্র কয়েক দিন আগের ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম, ‘হেলমেট ভাই’ নামে শহরের দেয়ালে নতুন একটি গ্রাফিতি অঙ্কন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের দেয়ালেও এই গ্রাফিতি দেখা গেছে। গ্রাফিতিতে দেখা গেছে, সুপারম্যানের সাজে মাথায় হেলমেট পরে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যক্তি। তাতে বিজ্ঞাপনের ভাষায় লেখা রয়েছে- বাজারে আসছে নতুন কমিকস ‘হেলমেট ভাই’। প্রাপ্তিস্থানের বিষয় উল্লেখ করে ‘গেস্টরুম’র কথা ও প্রকাশকের বিষয় উল্লেখ করে ‘সহমত ভাই’ লেখা হয়েছে। গ্রাফিতির এই ছবিটি সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও দেখলাম। অনেকেই ছবিটির ফেসবুক পোস্টে নানা মন্তব্য লিখে ভরিয়ে তুলেছেন। আমি কোনো মন্তব্য না করলেও কয়েকটি মন্তব্য পড়েছিলাম। দেখলাম, অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী ‘সাহসী প্রতিবাদ’, ‘শৈল্পিক প্রতিবাদ’, ‘সময়োপযোগী গ্রাফিতিসহ অনেক লম্বা-চওড়া মন্তব্য করেছেন। আর ‘হা হা’ রিঅ্যাক্টের জুড়ি নেই। এটা উপলব্ধি করা কঠিন নয় যে, ‘সহমত ভাই’ কথাটির প্রচলিত ব্যবহার মূলত ব্যঙ্গাত্মক অর্থেই তুলে ধরা হয়েছে এবং সমসাময়িক ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গটিও নির্দ্বিধায় চলে আসছে। এ বিষয়ে বলা যেতে পারে, যারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রতিপক্ষদের দমন করে, দুর্বলদের আঘাত করে, তাদের যেকোনো কাজের সঙ্গে মতামতে অমিল প্রকাশ করলে নির্যাতন বা হুমকির শিকার হতে হয় বলে সব কথায় গোসাপ্টা সমর্থন দেওয়াকেই ‘সহমত ভাই’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিরোধ আন্দোলনের রেশ ধরেই ব্যঙ্গ করে মূলত এই গ্রাফিতির জন্ম। কয়েক দিন আগে দেশজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সড়কে আন্দোলনে নেমেছিল। আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরে কিছু দুষ্কৃতকারী কর্তব্যরত সাংবাদিক ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলন শেষ হওয়ার অনেক পরে ‘হেলমেট ভাই’ গ্রাফিতি অঙ্কন করা হলেও হেলমেট পরে মুখ ঢেকে যারা হামলা করেছিল তাদের ইঙ্গিত করতে মূলত ‘হেলমেট ভাই’ বা ‘হেলমেট বাহিনী’ হিসেবে বলা হচ্ছে, এটা সুস্পষ্ট করেই বলা যায়।

‘হেলমেট ভাই’ গ্রাফিতির পূর্বে ‘সহমত ভাই’ গ্রাফিতি অঙ্কন করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রধান গেটের পাশের দেয়ালসহ অনেক জায়গায় গ্রাফিতিটি দেখা গিয়েছিল। ছবিতে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোর আদলে তৈরি এটি অঙ্কন করা হয়েছে; যাতে লেখা ‘সহমত ভাই’। আর প্রতিষ্ঠানের নামের জায়গায় লেখা ‘মেশিন’। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই নিয়ে অনেক রম্য রচনাও পাঠ করেছি। আর খুব কম সময়ের মধ্যে ‘সহমত ভাই’ কথাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ পরিচিতি লাভ করে। একই নামে পাবলিক পেজও রয়েছে। যেগুলোর ‘ডেসক্রিপশন’ (বর্ণনা)-এর জায়গায় লেখা রয়েছে- ‘সহমত ভাই সবচেয়ে পাওয়ারফুল নেতা’। এসব পেজ থেকে নানা ব্যঙ্গাত্মক পোস্টও দেওয়া রয়েছে। দু’একটি পোস্টের বিষয় এ পরিসরে উল্লেখ না করলেই নয়। একটি পোস্টে ফিলিং স্টেশনের একটি ছবি দেখা যাচ্ছে। মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি বলছেন, ‘তেল দে তো...।’ আরেকজন উত্তর করছেন, ‘সহমত ভাই..., রাজপথ ছাড়ি নাই..., আপনার আদর্শ ভুলি নাই...।’ আগের ব্যক্তিটি বলছেন, ‘আরে ভাই আমারে না, বাইকে তেল দে...।’ আরেকটি পোস্টে দেখা যায়- একজন বলছে, ‘সহমত ভাই’ লোকটার নাম শুনছি বেশ কিছুদিন যাবৎ। লোকটা আসলে কে? এ প্রশ্নের উত্তর করে লেখা রয়েছে, ‘আমরাও খুঁজছি। আপাতত কয়েক দিন আমরা খোঁজাখুঁজির মধ্যে আছি।...শীঘ্রই ‘সহমত ভাই’ আপনাদের সামনে হাজির হচ্ছে...।’ ফেসবুকে ‘সহমত ভাই’ ট্রল করে ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে অনেকে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে বিনাশর্তে কারো কথা মেনে নেওয়া বোঝাতে এটি ব্যবহার করছেন। এ যেন প্রতিরোধ আন্দোলনের যথোপযুক্ত বহিঃপ্রকাশ।

আমরা এর আগেও ‘সুবোধ চরিত্র’কে গ্রাফিতির মাধ্যমে দেখেছি। কিন্তু কেউ কি সেই সুবোধকে আবিষ্কার করতে পেরেছেন? সমাজের মোড় ঘোরাতে এই সুবোধদের খুঁজে ফেরা দরকার।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads