• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ঐক্যজোটে জামায়াত নেই আবার আছেও; শক্তি নিয়ে

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ঐক্যজোটে জামায়াত নেই আবার আছেও; শক্তি নিয়ে

  • সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন
  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গত ১৩ অক্টোবর গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ড.কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ.স.ম আব্দুর রব, মোস্তফা মহসিন মন্টু এরাই মূলত নতুন এই জোটের নেতৃত্বে আছেন। তাদের এই জোটে যোগ দিয়েছে দেশের অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি। তবে ড.কামালের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি জোটের অন্যতম শরীক স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের অবস্থান কোথায় সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সন্দেহও তৈরি হয়েছে জনমনে। আসলে জামায়াত এত চুপচাপ কেন? জামায়াত কি আছে কোথাও? নাকি নাই?

তবে এটা সত্যি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াত এখনও বিএনপির সঙ্গেই জোটবদ্ধ আছে। ফলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ সত্য প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে যে, পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীর সঙ্গেই ঐক্য হয়েছে ড.কামালদের। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক এগারোর কুশলিবরা।

এই জোটের আলোচনার শুরু থেকেই ছিল জামায়াত প্রসঙ্গ। কিন্তু ঐক্যের আলোচনায় মধ্যস্থতা করা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একটি কৌশলে অবশেষে জামায়াতকে ছাড়ার প্রশ্ন ছাড়াই বিএনপির সঙ্গে জোটে আবদ্ধ হয়েছেন ড. কামাল। জাফরুল্লাহর কৌশলটি ছিল – বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকবে জামায়াতের সঙ্গে, আর জাতীয় ঐক্য হবে বিএনপির সঙ্গে। ফলে এখানে জামায়াত কোনো বিষয় নয়। কৌশল মোতাবেক শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। তবে ঐক্যের আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাবি করেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য হয়নি। জামায়াতকে বাদ দিয়েই আমাদের ঐক্য হয়েছে।’ বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট থাকার পরও এই ঐক্যে জামায়াত নেই বলার সুযোগ আছে কি না, এই প্রশ্নে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘এটা নিয়ে তর্কে যাব না। আগামী নির্বাচনে জামায়াত কোনো ইস্যু হবে না।’

ড. কামাল হোসেনও বরাবরই স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে জোটে আপত্তি তুলেছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা শুরু থেকে বলে আসছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে সঙ্গে কোন জোটে তারা থাকবেন না। ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট করে বলেছিলেন, জামায়াত থাকলে তাঁর দল কোনো ঐক্য প্রক্রিয়ায় যাবে না। অন্য কোনো দল করবে কি না, তা তিনি জানেন না। জামায়াতকে রেখে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সারা জীবনে করিনি, শেষ জীবনে করতে যাব কেন? ওরা তো এখন দলও না। নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।’ একই কথা বলেছিলেন যুক্তফ্রন্টের অন্য নেতারাও।

তবে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এই জোটের অন্যতম শক্তি হয়ে থাকছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত। দলটি স্বনামে না থাকলেও নেপথ্যে বেশ শক্তিশালী ভাবেই আছে। জামায়াত ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন যুক্তফ্রন্টের অন্যতম দল বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত ড. কামালরা বিকল্পধারাকে বাদ দিয়েই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে। আর এই ঐক্য হয়েছে মুলত জামায়াতের ইচ্ছে ও পরিক্ল্পনায়। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও মাহি বি চৌধুরীর ফাঁস হওয়া টেলিসংলাপ থেকেই বিষয়টা স্পষ্ট।

ওই ফোনালাপে মাহী বি. চৌধুরী জাতীয় ঐক্য নিয়ে ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। মাহি বলেন, এখানে আসলে ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে একটা চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র হইতেছে। এখানে কোন রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আপনাকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করাইতেছে। আমাকেও ঢুকানোর চেষ্টা করছিল। আজকের এই কথাটা শুধু মনে রাইখেন। আর কিছু বলবো না। ঐক্যফ্রন্ট গঠনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে মাহি বলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে, আজকের এই ঘটনা এমনি এমনি ভুলে ভুলে হয়ে গেছে? এর বাইরে এর পেছনে কোন জাতীয় আন্তর্জাতিক চক্রান্ত নাই?।

১/১১-এর অন্যতম কুশীলব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কোন রাজনৈতিক দল নেই, নেই জনপ্রিয়তাও। তবুও তিনি ঐক্যফ্রন্টের অন্যমত নেতা। মূলত জামায়াতের প্রতিনিধি হয়েই তিনি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইতিহাস ঘাটলেও অতীতে মইনুলের সঙ্গে জামায়াতের ব্যপক সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যারিস্টার মইনুলের জামায়াত কানেকশন নিয়ে বর্তমানে সরগরম দেশের মিডিয়া।

২০০৫ সালে শিবিরের এক সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে শিবিরের আদর্শিক বিষয়গুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ব্যারিষ্টার মইনুল ইসলাম, সেসময় তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রশংসাও করেন। এখনো তিনি বিএনপি এবং জামায়াতের মতাদর্শের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে চলছেন। শিবিরের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তাদের আদর্শের সঙ্গে একই সুরে কথা বলে ব্যারিষ্টার মইনুল ইসলামের বক্তব্য দেয়াকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তার আদর্শিক সমস্যা ও ক্ষমতার লিপ্সা বলেই অভিহিত করেছেন।

এদিকে গত ১৬ অক্টোবর একাত্তর টিভির এক অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মইনুলের কাছে জামায়াত কানেকশন বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলে প্রকাশ্য লাইভ অনুষ্ঠানে গালি দেন তিনি। ব্যারিস্টার মইনুলের কাছে মাসুদা ভাট্টির প্রশ্ন ছিল: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আলোচনা চলছে যে, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ঐক্যফ্রন্টে জামাতের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এর জবাবে ব্যারিস্টার মইনুল বলেন, “আপনার দুঃসাহসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনি চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই”। লাইভ অনুষ্ঠানে একজন নারীকে চরিত্রহীন বলে গালি দেওয়ার ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্লেষন করে দেখা গেছে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে দেশে এবং বিদেশে একটি সেক্যুলার ভাবমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের পর ‘জামায়াত’ ক্ষত আরো দগদগে হয়ে উঠেছে বিএনপির জন্য। যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন বিএনপি জোট বাঁধত আগ্রহী হয়, তখন ওই দুই জোটের প্রধান শর্তই ছিলো বিএনপি জামায়াত ছাড়তে হবে। যুক্তফ্রন্ট বলেছিল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। ড. কামাল হোসেনও প্রথমে এ বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু ‘জামায়াত’ কাছে রাখতে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে ম্যানেজ করে ফেলে। কিন্তু বিকল্পধারা কিছুতেই বিএনপি-জামাতের জোট থাকা অবস্থায় বিএনপিকে জোটে নিতে রাজি ছিলো না। এ জন্যই মূলত বিএনপির চাপেই ড. কামাল অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ফ্রন্ট গঠন করে। কিন্তু বিএনপি-জামাত প্রেমের কারণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন মহল থেকেই সহানুভূতি পাচ্ছে না বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট।

সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ফ্রন্টের দাবি দাওয়ায় সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে জামায়াত ইস্যু। একাধিক কূটনিতিকরা প্রশ্ন করেছেন, বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নিয়ে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কি? তাও জানতে চেয়েছেন। ড. কামাল হোসেন অবশ্য বলতে চেয়েছেন, জামায়াত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। কিন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এটা মানতে রাজি নন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে, তাদের কাছে তথ্য আছে যে জামাতের ৩ থেকে ৭ জন ভালো প্রার্থী আছে; যারা বিএনপির প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। ইউরোপীয় নিউনিয়ন এটাও মনে করছে যে, শেষপর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট একসঙ্গে নির্বাচনে গেলে তাদের প্রতীক হবে ধানের শীষ। তাহলে তখন কি বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট একাকার হয়ে যাবে না? কূটনীতিকদের এই প্রশ্নের জবাব নেই ফ্রন্ট নেতাদের। ফলে ফ্রন্টও জামায়াত সংগ নিয়ে থাকা ফ্রন্টের দাবিদাওয়া নিয়ে আগ্রহী না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পেছনে মার্কিন দূতাবাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্ত জামায়াত থাকায় এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই জোটের ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলেই জানা গেছে। শুধু বিদেশী কূটনীতিকরাই নন, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন দেশের সুশীল সমাজেরও একটি অংশ। তারাও আশা করেছিলেন, এরকম ফ্রন্ট করলে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে।

জামায়াতের সঙ্গে জোট হয়নি বলা হলেও আদতে এই জোটের অন্যতম শরীক জামায়াত। ভোটের রাজনীতির জন্য জামায়াতকে তাদের দরকার। সেই জায়গা থেকে জামায়াতকে ছাড়ছে না বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে জামায়াতের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। তারা ক্যাডার ভিত্তিক রাজনীতি করে। এছাড়া সারা দেশে ৫০-৬০ আসনে জামায়াতের পাঁচ শতাংশ ভোট বিএনপির জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। জামায়াতকে ছেড়ে ঐক্য করলে সরকারি দল সুবিধা পেত।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা জামায়াতকে রেখে এই ঐক্যের ভবিষ্যত পূর্বের ২০ দলীয় জোটের মতোই। গণফোরাম এবং যুক্তফ্রন্ট অতীতেও নিজেদের তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কেবল স্বপ্নই রয়ে গেছে। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট জিতলেও জামায়াত বিএনপিই সরকার গঠন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।♦

 

লেখক : সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads