• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলাদেশে কেন ‘মি টু’ নয়

বাংলাদেশে অধিকাংশ যৌন নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে না

সংগৃহীত ছবি

মতামত

অভিমত

বাংলাদেশে কেন ‘মি টু’ নয়

  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০১৮

এমদাদুল হক সরকার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক কিংবা টুইটারের নিউজফিডে চোখ রাখলে আপনি দেখবেন প্রতিদিনই কোনো না কোনো তারকা অথবা কেউ না কেউ ‘#MeToo’ লিখে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। খবরের কাগজেও দেখতে পাবেন এ নিয়ে খবরের পর খবর! কিন্তু ‘মি টু’ আসলে কী?

কিছু শব্দ আছে দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। ‘মি টু’ তেমন দুটি শব্দ, যা শুধু নিছক শব্দে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বকে অভিঘাত করেছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত শব্দ এই ‘মি টু’। টপ অব দ্য টক ‘মি টু’ সম্পর্কে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯৭ সালে। সমাজকর্মী টারানা বার্ক ১৩ বছরের এক কিশোরীর মুখে তার ওপর যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন। শুনতে শুনতে তখনই তার বুকের ভেতর জন্ম নিয়েছিল ‘মি টু’ অর্থাৎ আমিও নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এটা শুধু শব্দ নয়, যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা এক সরব আন্দোলনের নাম, প্রতিবাদের নাম।

নিরবধি কাল ধরে মেয়েরা বিশ্বের সর্বত্র যৌনহিংসার শিকার হলেও কৃষ্ণাঙ্গ বার্কের ২০০৬ সালে গড়ে তোলা ওই আন্দোলনকে বিশিষ্ট শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীরা অবশ্য দীর্ঘদিন পাত্তা দেননি। শেষ পর্যন্ত হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা প্রযোজক হারভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যৌনপীড়নের একাধিক অভিযোগ প্রকাশ্যে উঠে এলে ওই ‘#MeToo’ ছড়িয়ে পড়ে আলিসা মিলানোর হাত ধরে।

বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় যৌন নির্যাতনের বা হয়রানির প্রতিবাদে ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে জনপ্রিয় ক্যাম্পেইন চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হলিউড পেরিয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পড়েছে এর তীব্র ছোঁয়া। বলিউড এখন ‘মি টু’ নিয়ে সরগরম। একের পর এক যৌননিগ্রহের অভিযোগ আনছেন বলিউড তারকারা। নানা সময়ে যৌন হেনস্তা নিয়ে মুখ খুলেছেন তারা। তনুশ্রী দত্ত সম্প্রতি অভিযোগ এনেছেন নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে। তনুশ্রীর পর একে একে অনেক বলিউড তারকা যৌননিগ্রহের শিকার হওয়া নিয়ে মুখ খুলেছেন। ভারতে চলমান ‘#MeToo’ ক্যাম্পেইনে ফেঁসে গেছেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে বলিউডের রথী-মহারথীরা। ভদ্রতার আড়ালে মহারথীদের জীবনের কালো কিছু অতীত প্রকাশ্যে এসে গেছে ‘#MeToo’র সৌজন্যে। এই আন্দোলন এবার মুখোশ খুলে দিয়েছে অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান, ভূষণ কুমার, শত্রুঘ্ন সিনহাদের। বলিউডের বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে এক নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে চাকরিচ্যুত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া ভারতের ইতিহাসে প্রথম কোনো প্রতিমন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর) পদত্যাগ করেছেন ‘মি টু’র কারণে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে এখনো ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়নি কেন? বাংলাদেশে কি নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন না? একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ বলছে, ২০১৭ সালজুড়ে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে যৌন সহিংসতার নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা। ইউনিসেফের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আক্রান্ত হয় তাদের কাছের মানুষের দ্বারা। ঢাকায় যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ওপর এক কর্মশালায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের প্রায় ৭০ ভাগই স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন, আর এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন সংস্থার দ্বারস্থ হন।

সম্প্রতি সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৪২৭ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ২০৮ জন, নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় ১৪৪ জনকে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৫৬ শিশু এবং নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪৮ শিশুকে। এ ছাড়া নারী-শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৬৬ হাজার মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে বলে জানানো হয়, যার ৯৭ শতাংশ মামলায় কোনো সাজা নেই।

বাংলাদেশে অধিকাংশ যৌন নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে না। কারণ অনেক পরিবার বিভিন্ন হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন কিংবা ক্ষমতাবানদের তোপের মুখে পড়ে চুপ থাকেন। তাহলে বিচারহীন সংস্কৃতি কি বাংলাদেশে ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু না হওয়ার অন্যতম কারণ, নাকি নারীদের সত্য প্রকাশের সাহস নেই?

বিচারহীনতার কারণে যদি নারীরা চুপ থাকে, তাহলে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পরিবহন সেক্টর— সর্বত্র তারা আরো বেশি নির্যাতনের শিকার হবেন। তাই এদেশের নারীদের এখনই রুখে দাঁড়ানোর সময়। আসুন ‘#MeToo’ আন্দোলন বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে সভ্যতার মুখোশপরা ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচিত করি।

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads