• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আখতারের অনশন ও ‘মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ’

প্রতীকী ছবি

মতামত

আখতারের অনশন ও ‘মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ’

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ২৫ অক্টোবর ২০১৮

‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে অনশনরত আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আখতার হোসেনের পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক বাঙালি লেখক আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ বইটি পাঠরত দেখলাম। ব্যাকগ্রাউন্ডে যে প্ল্যাকার্ডগুলো ছিল, তার চেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তার হাতের বইটি। যারা বইটি পড়েছেন, তারা আখতারের অনশন ও হাতে দৃশ্যমান বইয়ের মাধ্যমে প্রসঙ্গ টেনে যে বার্তা দিচ্ছে তা বুঝতে পারবেন। মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, শেষ পরিণতি বিশ্লেষণে আখতারের অনশনের কারণের সঙ্গে উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা শতভাগ- বইটি আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চাসনে বসার কলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।  

আমাদের দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রতিবারই ঘটছে। কিন্তু নেপথ্যের কুশীলবরা অধরা ছিল, আছে এবং থাকবে। চুনোপুঁটি সব ধরা খাচ্ছে আবার অদৃশ্য ইশারায় পারও পেয়ে যায়। ‘বলাৎকারের’ শিকার ফটোকপির দোকানি, পিয়ন বা কর্মকর্তা-কর্মচারী। উদাহরণ চাইলে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দেখতে পারেন। যে শিক্ষক মূল হোতা, তিনি কিছুকালের জন্য মামুলি শাস্তি পেলেন। আর যত দোষ চাপলো বেচারা ফটোকপির দোকানির ঘাড়ে, তার শাস্তির পাল্লাও ভারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বলতে গেলে প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, কিন্তু প্রতিকার নেই। এ ছাড়া দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন ‘ডাল-ভাত’ ব্যাপার। ১৮ অক্টোবরের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় দেখলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের জন্য অ্যামাজন থেকে ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয় করা হয়েছে, মাঠে দশটি চক্র ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সক্রিয়। রাবি ছাত্রলীগের এক নেতার ফোনালাপও ফাঁস হয়েছে। এরকম ঘটনা প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই। গত বছর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির কলঙ্ক এখনো মোছেনি। কয়েক বছর আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ১৮ টাকায় ফটোকপির দোকানে পাওয়া গেছে। এই যে মহামারী, এর শেষ কবে হবে? 

মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন, গোয়ালঘর হয় ভিসি অফিস। পতিত ও স্বার্থান্বেষী কিছু শিক্ষকদের ভজনা চলে গোয়ালঘর ঘিরে; তেল আর চাটুকারিতাই যাদের সম্বল। ছফার অমর কীর্তি ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসের আখ্যান, চরিত্রলিপি, পরিবেশ বর্ণনা ও লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন বর্তমান সমাজ-বাস্তবতার আলোকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অবস্থা, সে প্রসঙ্গ বর্ণনার জন্য আখতারের কৌশলের আবেদন পূর্ণমাত্রায় আছে। স্মর্তব্য যে, মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি সাধন হয়েছে। তিনি দেশসেরা শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীর কাতারে স্থান পেয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সেমিনারের ডাক পেয়েছেন। তাই মহামারীর শেষ নেই। 

‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থী যখন ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হয়, তখন ঢাবির সম্মানিত প্রক্টর মহোদয় বলেন, ‘এটিকে আমরা অস্বাভাবিক মনে করছি না।’ প্রক্টর মহোদয়ের এমন আত্মবিশ্বাসপূর্ণ বক্তব্য অট্টহাসি সমেত হাততালি পাওয়ার দাবি রাখে। আরো ভাষ্য হচ্ছে, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের নিশ্চিত কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।’ প্রক্টর মহোদয়ের বক্তব্য শতভাগ যৌক্তিক ও সত্য বলে মেনে নেওয়া যেত, যদি পরীক্ষার দিন সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ৭২টি প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষায় প্রদত্ত প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল না থাকত। সবচাইতে বড়কথা হলো, ঢাবির মাননীয় উপাচার্য মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট বলেছেন, আগে দু-তিনদিন পূর্বে প্রশ্ন ফাঁস হতো আর এখন ৪২ মিনিট আগে হয়েছে, আমরা সময় অনেক কমিয়ে এনেছি। তিনি স্পষ্ট স্বীকার করে নিয়েছেন প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আর এ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে, যা উপাচার্য মহোদয়ও বলেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘তদন্ত কমিটি ডিজিটাল জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর, ৩য় পৃষ্ঠা) উপ-উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৫ তারিখে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিল। ১৯ তারিখের দৈনিক যুগান্তরের তথ্যমতে, দেড় থেকে ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে। শিক্ষক, ছাত্রনেতাসহ ৩৭ জনের কয়েকটি চক্র এতে জড়িত। তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে এতগুলো প্রমাণ ও উপাচার্য মহোদয় স্বীকার করার পরও প্রক্টর মহোদয় স্বীকার করছেন না কেন? আর উপাচার্য মহোদয় যখন জেনেই গেছেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তাহলে কেন তিনি সিদ্ধান্ত নিতে এত জল ঘোলা করছেন? প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয় যখন ১৫ তারিখেই প্রমাণিত হয়েছিল, ১৬ তারিখে ফল প্রকাশ করার যৌক্তিকতা নিয়ে ঢাবি প্রশাসনের আরো ভাবা উচিত ছিল। এই লেখা প্রকাশিত হতে হতে ঘোলা জল আরো অনেক দূর গড়াবে। হয়তো পরীক্ষা বাতিলও হবে।  

তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থীর বোধ জাগ্রত হয়েছে কিন্তু আমাদের শিক্ষক সমাজের জাগ্রত হয়নি। যদি বোধশক্তি থাকত, তাহলে আখতার হোসেনকে অনশন করতে হতো না। আগে শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হতো; কিন্তু তা হবে না। কারণ এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয় না, হয় দলীয় বেকারদের কর্মসংস্থান ও পকেট ভর্তি করার টেন্ডার। প্রকৃত শিক্ষক সমাজ সবসময় শিক্ষার্থীদের উত্তর সাধক- কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, আখতারের অনশন, এটা ভুল প্রমাণ করেছে। এ যৌক্তিক আন্দোলনগুলোতে শিক্ষকদের মাঠে নামা তো দূরে থাক, সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি (কয়েকজন বিবেকতাড়িত শিক্ষক বাদে)। আর যে কজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তাদের মধ্যে দু-একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন, কেউ এখন জেলে। শিক্ষক সমাজের বড় একটি অংশ এ আন্দোলনগুলো নিয়ে নানা সময় মিথ্যাচার ও বিরূপ মন্তব্য করেছে। ঢাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অবহিত করে শিক্ষকদের একটা অংশ মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে। ইতিহাসের শিক্ষকদের এই কর্ম কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads