• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
খরচের চাপে হিমশিম জীবন

সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষেরা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

খরচের চাপে হিমশিম জীবন

  • আ.ব.ম রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০১৮

এই সরকারের আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অনান্য পেশার মানুষের আয়ও বেড়েছে। মঙ্গা বিদায় নিয়েছে এ দেশ থেকে। এ দেশকে এখন কেউ আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না এবং বলতে সাহসও পায় না। এখন আর কেউ না খেয়ে মারা যায় না মনে হয়। কিন্তু এসবের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। খরচ বেড়েছে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। একক রোজগার দিয়ে বর্তমান অবস্থায় সংসার চালানো কষ্টকর।

দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ানোয় সরাসরি এর প্রভাব পড়েছে পরিবারের ব্যয়ে। এ কারণে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বড়েছে তাতে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষেরা।

সংসারের অন্য খরচের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে  শিক্ষাক্ষেত্রের খরচ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচের চাইতে কয়েকগুণ বেড়েছে প্রাইভেট, কোচিংয়ের খরচ। সত্তর, আশির দশকে এই ক্ষেত্রে এতটা খরচ করতে হয়নি। সরকার বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের নতুন বই দিয়েছে-এ কথা সত্য এবং তার জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়াতে এবং অন্যান্য কারণে  শিক্ষার্থীদের নোট গাইড কিনতে হচ্ছে বিপুল দামে। এই ক্ষেত্রে অভিভাবকরা চাপে আছে প্রচণ্ড। একটি পরিবারে দুটি শিক্ষার্থী থাকলে ওই পরিবারের অভিভাবককে গুণে গুণে প্রতিমাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে ওই দুটি শিক্ষার্থীর পেছনে। অভিভাবকরা শত কষ্ট বুকে চেপে ধারদেনা করে হলেও এ ক্ষেত্রে কেউ পিছু হটে না। নিজে শিক্ষিত না হলেও এ দেশের মানুষ তার সন্তানকে নানা কষ্টে শিক্ষিত করতে চায়।

দুই সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করে ভাড়া বাসায় থেকেও কষ্টে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। কারণ সব খাতেই ব্যয় বেড়েছে, আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে অনেকে বাড়তি খরচ মেটাতে চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম জব, আউট সোর্সিং ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে। খরচের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে মুঠোফোনের খরচ। এ দেশে প্রায় পরিবারে নানা বয়সের মানুষের জন্য মুঠোফোন আছে এবং তা একাধিক। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু অনেক মানুষের মোবাইল, ফেসবুক, টিভি সিরিয়াল এখন নিত্যসঙ্গী। তাতে যা খরচ হওয়ার হোক। ফলে প্রতিটি সংসারে বাড়তি খরচ হিসেবে যুক্ত হয়েছে এ খরচটি।

বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পরিবারে স্থির ব্যয় বেড়েছে মূলত বাসা ভাড়া, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাবদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের দাম না বাড়ানোর কথা বলার পরও গত মাসে প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম দেড়শ টাকা বেশি দিতে হয়েছে ক্রেতাদের। অদ্ভুত লাগে এসব ক্ষেত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যার যা খুশি করে যাচ্ছে  আবার কোনো কোনো বাজার সিন্ডিকেট এ ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ছে। কেবল টেলিভিশনের (ডিশ) সংযোগ ফি, গৃহকর্মীর মজুরি, এমনকি ময়লা ফেলার জন্যও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় পরিবারকে। এ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই।

কাঁচাবাজার, মাছের বাজার, মাংসের বাজার, ভোজ্যতেলের বাজারে যারা নিত্যদিন যান তারা অতিরিক্ত ব্যয়টা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন বোধকরি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ক্যাবের এই হিসাব ১১৪টি খাদ্যপণ্যে, ১৪টি সেবার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি। এতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

ক্যাব বলছে, রাজধানীসহ প্রতিটি বড় বড় শহরে ২০০৯ সালে দুই শয়ন কক্ষ বা বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৬ সালে তা ১৯ হাজার ৭০০ টাকায় উঠেছে। আলোচ্য সময়ে এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৯৩ শতাংশ, পানির দাম ৫৬ শতাংশ এবং প্রতিকিলোমিটার বাসা ভাড়া ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। ব্যয় বাড়তে থাকায় ব্যয়বহুল নগরী হয়ে উঠেছে ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনও কঠিন হয়ে উঠেছে ব্যয় বৃদ্ধির চাপে। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকার শীর্ষ শহর এখন ঢাকা।’ কষ্ট অব লিভিং সার্ভে শীর্ষক এ জরিপ খাবার, পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য  সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।

ব্যয় বৃদ্ধির চাপে দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। বিপরীতে খরচ ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। ফলে সাশ্রয় হতো ২৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে একটি পরিবার সাশ্রয় করতে পারত ২৩০ টাকা। আলোচ্য বছরে একটি পরিবারের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা এবং ব্যয় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।

গ্রামের মানুষ আছেন আরো বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয় আয়ের চেয়ে ২৮৮ টাকা বেশি।

বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, পরিস্থিতি প্রকাশের সবচেয়ে ভালো সূচক ভোক্তা মূল্যসূচক। আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এতে বড় আঘাত আসে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। দারিদ্র্যসীমার নিচের দিকে থাকা ২০ শতাংশ  মানুষের দৈনিক খরচের ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। এ ক্ষেত্রে চালের মূল্য ১০ টাকা বৃদ্ধি মানে দরিদ্র মানুষের আয় ৪ টাকা কমে যাওয়া।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক বারো শতাংশ। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা ৩৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মানুষকে সচেতন হতে হবে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে। পণ্যের দাম অস্বাভাবিক লাগলে একজন ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। সরকারের সেবা সংগঠনগুলোকে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক

robiulislam794@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads