• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
এমন পরিণতি সত্যিই বেদনাদায়ক

রাজনীতি

প্রতীকী ছবি

মতামত

এমন পরিণতি সত্যিই বেদনাদায়ক

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০১৮

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের পর অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী যখন পুনরায় রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন, তখন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন-‘পর্বতের চূড়ায় উঠে কেউ যদি আরো উপরে ওঠার জন্য লাফ দেয়, তাহলে গভীর খাদে নিপতিত হওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর থাকে না।’ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বর্তমান অবস্থা এবং অবস্থান বিবেচনায় সৈয়দ আবুল মকসুদের মন্তব্যের যথার্থতা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক পর্বতের চূড়ায় তো উঠেছিলেন তিনি। দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার পর আর কী কাম্য বা অপ্রাপ্তি থাকতে পারে তার? কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে তিনি সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন। কেন ঘটেছিল সে ঘটনা তার সঠিক কারণ আজো সাধারণের অজানা। নানাজন নানা কথা বলেন। তবে সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, তিনি তৎকালীন সরকারের শীর্ষ মহলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আস্থা হারিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। যে কারণে যেদিন বিএনপির সংসদীয় কমিটির সভায় তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়, সেদিন একমাত্র স্বীয় পুত্র মাহী চৌধুরী ছাড়া তার পক্ষে আর কেউ কথা বলেননি।

ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর আগে নির্বাচিত কোনো রাষ্ট্রপতিকে স্ব-দলের অনাস্থার মুখে পদত্যাগ করতে হয়নি। শোনা যায়, সরকারপ্রধানের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। আর সে অবনতির অন্যতম কারণ ছিল পুত্র মাহী চৌধুরীর অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি। ২০০২ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাসে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর স্টেডিয়ামে জনসভা করতে গেলে মাহী চৌধুরী চার-পাঁচটি তোরণ নির্মাণ করে তাকে স্বাগতম জানান। গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের দিক থেকে মাহীর এ কাজটি অনৈতিক না হলেও আমাদের রাজনৈতিক কালচারে তা ছিল অনভিপ্রেত। সেসব তোরণের ছবি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সরবরাহ করা হয়েছিল ওই এলাকা থেকেই। এ ছাড়া ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে তার মাজারে শ্রদ্ধা না জানানোর ব্যাপারটি বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীই মেনে নিতে পারেননি। তা ছাড়া জিয়ার শাহাদাতবার্ষিকীতে তিনি যে বাণী দিয়েছিলেন, তাও ছিল অত্যন্ত সাদামাটা এবং কারো কারো মতে অবমাননাকর। এ বিষয়টিও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ক্ষুব্ধ করেছিল।

২০০২ সালের ১৯ জুন অনুষ্ঠিত বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়। যারা তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিলেন, দলীয় সেই সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন বি. চৌধুরী। তরুণ সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা সবাই যদি শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে তোরণ নির্মাণ শুরু করি, তাহলে আপনার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর যিনি নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার মাজারে যান না, তার কী অধিকার আছে সে দলের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকার? দু’দিন চলেছিল বিএনপি সংসদীয় দলের সে সভা। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা বেগম খালেদা সবশেষে বলেছিলেন, ‘আমার মনেও অনেক কষ্ট-ক্ষোভ আছে। আজ আমিও আপনাদের সঙ্গে একমত।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ জুন, ২০০২)। ব্যস! ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল ডা. বি. চৌধুরীর। বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি ইস্তফা দিলেন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে।

বি. চৌধুরী পেশাদার কোনো রাজনীতিক ছিলেন না। ছাত্রজীবন বা অন্য কোনো পর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তার ছিল না। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার অত্যন্ত কাছের লোকে পরিণত হয়েছিলেন বি. চৌধুরী। দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে অন্যদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত ছিলেন তিনি। নব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি অতি দ্রুত দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে এবং একই সঙ্গে অর্জন করে জনপ্রিয়তা। তবে এ ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ইমেজ ও জনপ্রিয়তাই ছিল মূল কারণ। ক্ষমতাসীন দলে লোক পেতে আমাদের দেশে তেমন কষ্ট হয় না। তেমনি বিএনপির চারপাশেও এসে ভিড় জমায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। মহাসচিব হিসেবে এক্ষেত্রে বি. চৌধুরীর ভূমিকা তেমন একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত এবং পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান এরশাদের সামরিক শাসনের সময় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বিএনপি। যে সময়ে মহাসচিব হিসেবে বি. চৌধুরীর দলের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রাখার কথা, দেখা গেল তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মহাসচিবের পদ থেকে সরে গেলেন।

অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিএনপি এরশাদ সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে বি. চৌধুরীকে করা হয় শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন। সে সময় তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তা চায়নি। তাই মন্ত্রী না থেকে শুধু সংসদীয় দায়িত্ব পালন করবেন বলে সিদ্ধান্তের কথা দলকে জানান। বি. চৌধুরীর রাষ্ট্রপতি হওয়ার সে ইচ্ছা পূরণ হয় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, মাত্র সাত মাসের মাথায় তাকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হয়।

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের পর বি. চৌধুরী বলেছিলেন, আর রাজনীতি করবেন না তিনি। তবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবেন। কেউ যদি পরামর্শ বা সহযোগিতা চায়, তিনি তা করবেন। কিন্তু নিজের কথা থেকেই সরে গেলেন তিনি। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে গঠন করলেন বিকল্পধারা। এরপর ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি। তিনি হন প্রেসিডেন্ট আর অলি আহমদকে করা হয় কো- চেয়ারম্যান। ওই সময় রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল এই চিরবৈরী দুই নেতা একসঙ্গে কতদিন চলতে পারবেন। অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, অচিরেই এই দুজনার দুটি পথ দুদিকে বেঁকে যাবে। বাস্তবে হলোও তাই। মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভেঙে গেল এলডিপি। বি. চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে পুনরায় বিকল্পধারাকে জীবিত করলেন আর কর্নেল (অব.) অলি এলডিপি নামটি দখলে নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে থেকে গেলেন। এলডিপি প্রতিষ্ঠার আগে বি. চৌধুরী ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম ও বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ সমন্বয়ে তিনদলীয় একটি জোটও করেছিলেন। কিন্তু সে জোট বেশিদূর হাঁটতে পারেনি।

শুনতে ভালো না লাগলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বিএনপি থেকে বাইরে চলে যাওয়ার পর দেশের রাজনীতির মাঠে অবস্থান ধরে রাখার জন্য নানা কায়দা-কসরৎ করেছেন বি. চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে অবস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে শরিক হওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নৌকার ছৈয়ের নিচে তার জায়গা হয়নি। ব্যর্থ মনোরথ বি. চৌধুরী অগত্যা নিজের বিকল্পধারা নিয়েই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিকল্পধারা থেকে তিনি তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নিজ এলাকা মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে তিনি মাত্র ৩৬ হাজার ভোট পান। আর মুন্সীগঞ্জ-২ ও ঢাকা-৭ আসনে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও নেতা বা প্রার্থী হিসেবে বি. চৌধুরী এমন কোনো ইমেজ তৈরি করতে পারেননি, যা তাকে ভোটে বিজয়ী করতে পারে। একই অবস্থা হয়েছে তার পুত্র মাহী চৌধুরীর। ২০১৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনিও জামানত হারিয়েছেন।

সর্বশেষ জাতীয় ঐক্য গঠন করতে গিয়ে ডা. বি. চৌধুরী তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন ধাক্কাটি খেলেন। যে ঐক্যজোট গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি, সে ঐক্য গঠিত হলো তাকে বাদ দিয়েই। শুধু তা-ই নয়, এ ঐক্যজোট গঠন প্রশ্নে তার দল বিকল্পধারাও ভেঙে গেছে। গত ১৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলটির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূরুল আমিন বেপারি ও সহ-সভাপতি শাহ আহমদ বাদলের নেতৃত্বে বিকল্পধারার নতুন কমিটি গঠন এবং দল থেকে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও মাহী চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। অবশ্য পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে মাহী চৌধুরী ওই ঘটনাকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, যারা অব্যাহতির কথা বলেছেন, তাদের এক মাস আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

কে কাকে বহিষ্কার করেছে বা করার এখতিয়ার রাখে না, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। নির্মম সত্য হলো, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা আর অক্ষত নেই। সবচেয়ে লক্ষ্যযোগ্য বিষয় হলো, এর আগেও বিকল্পধারা দুইবার ভাঙনের শিকার হলেও বি. চৌধুরী বা মাহী চৌধুরী বহিষ্কার বা অব্যাহতির কবলে পড়েননি। এবার সে ঘটনাই ঘটেছে। কেন এমনটি ঘটল? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বি. চৌধুরীর রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা পর্যালোচনা করলেই এর কারণটি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাজনীতির জগতে নিজস্ব কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। যে জন্য রাষ্ট্রপতির পদ থেকে যখন তাকে পদত্যাগের চাপ দেওয়া হয়, একজনও তার পক্ষে কথা বলেননি। বিএনপির বাইরে গিয়ে একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টা তিনি কম করেননি। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এবার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার মতো অবস্থান তৈরির। কিন্তু পুত্র মাহী চৌধুরীর অতি বাড়াবাড়ি এবং তার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে সে সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেল।

এখন কী করবেন বি. চৌধুরী? কোন পথে এগোবেন? তিনি কী আরো কিছুদিন রাজনীতির অঙ্গনে সক্রিয় থাকবেন, নাকি এখানেই ইতি টানবেন? এসব প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনো জবাব হয়তো নেই। তবে এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়, যে জিনিস তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, তার পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং রাজনীতিক। আজকে তার যে পরিণতি তা অনিবার্যই বলা যায়। কারণ, রাজনীতিতে একটি অতি সামান্য ভুল ডেকে আনতে পারে চরম বিপর্যয়। বি. চৌধুরীর ক্ষেত্রে সে রকমই ঘটেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন। দেশের প্রথম সারির এ রাজনীতিকের এমন পরিণতি সত্যিকার অর্থেই বেদনাদায়ক।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads