• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
সমঝোতার মাধ্যমে কৃষিঋণ আদায় করা হোক

কৃষক চাষাবাদ করবে নির্বিঘ্নে, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

সমঝোতার মাধ্যমে কৃষিঋণ আদায় করা হোক

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০১৮

কৃষি ও কৃষকই জাতির মেরুদণ্ড। কৃষির সমৃদ্ধি দেশকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে, যা স্বীকার করতেই হবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে মানুষের মুখের আহার জোগান দিচ্ছে কৃষক। যাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় দেশে ধান, গমসহ সবজি চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। কিন্তু সে দেশের কৃষকের অবস্থার উন্নতি হয়নি। জলবায়ুজনিত নানা অভিঘাত মোকাবেলা করে যারা ফসল ফলায়- কখনো কখনো আগাম বন্যা, খরা কিংবা অতিবৃষ্টির কবলে পড়ে উঠতি ফসল নষ্ট হওয়ায় তাদের কষ্টের শেষ থাকে না। আবার যারা ঘুরে দাঁড়াতে কোমর বেঁধে মাঠে নামতে দ্বিধাও করে না, সেই কৃষককে সামান্য ঋণের টাকা পরিশোধের ব্যর্থতায় ব্যাংকগুলো মামলা দিয়ে কোমরে রশি লাগায়। এটাই যেন এ দেশের কৃষকের নিয়তি! একসময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা চাষিদের নানাভাবে নির্যাতন করে নীলচাষে বাধ্য করত। প্রতিবাদ করার ন্যূনতম অধিকারটুকু ছিল না। নীল চাষে বাধ্য করতে জমিদার জোতদারদের লাঠির আঘাতই ছিল যাদের প্রাপ্য। সেই কৃষকের মুক্তির লড়াই শুরু হয়েছে তখন থেকেই। স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হবে, নীল চাষ বন্ধ হবে, শোষণ-বঞ্চনা বন্ধ হবে। আর লাঠিয়ালদের লাঠির আঘাত সইতে হবে না। কৃষক চাষাবাদ করবে নির্বিঘ্নে, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে। বদল হবে ভাগ্য। কিন্তু সবই যেন মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। সত্যিই দেশ স্বাধীন হয়েছে। জোতদার, জমিদারের লাঠির আঘাত বন্ধ হয়েছে। নীলচাষ বন্ধ হয়েছে সত্য, তবুও যেন কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। এখনো এ দেশের কৃষককে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শোষণ করা হচ্ছে। জমিদার, জোতদারদের বদলে দেশীয় নব্য শোষক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কৃষক পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়েছে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪৭ বছর আগে। আর তিন বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। হয়ত অনেক বক্তা এ দেশের সাধারণ কৃষকের ভাগ্য বদলের নানা খতিয়ান তুলে ধরবেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ দেশের কৃষকের ভাগ্যের বদলের পরিবর্তে ভাগ্যাহতদের খতিয়ান হয়ত ক্ষমতাসীনরা কোনো দিন তুলেও ধরবেন না কিংবা স্বীকারও করবেন না। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ দেশের মধ্যবিত্ত কৃষকের যে পরিমাণ চাষের জমি ছিল, আজ কিন্তু সে চাষের জমি তাদের হাতে নেই। যা অভাব অনটনে বেঁচে থাকার তাগিদে পানির দামে বিক্রি করেছে নব্য শোষক গোষ্ঠীর প্রতীক মহাজন ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতিদের কাছে। ওরা হয়েছে ভূমিহীন কিংবা বর্গাচাষি। যারা বাপ-দাদার বসতভিটা পর্যন্ত বিক্রি করে আশ্রয় নিয়েছে নগর-মহানগরগুলোর বস্তিতে, ওরা আজ বস্তিবাসী। আর এখনো যারা বেঁচে থাকার লড়াই করে জমিতে চাষাবাদ করছে, এমন প্রান্তিক চাষি কিংবা বর্গাচাষিরা ফসল চাষ করেও উপযুক্ত মূল্যের অভাবে লোকসানের মুখে পড়ে মহাজনী দেনা কিংবা ব্যাংক থেকে নেওয়া সামান্য ঋণের অর্থও পরিশোধ করতে পারছেন না। গত ৭ অক্টোবর রোববার দৈনিক বাংলাদেশের খবরে প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দুই লাখ প্রান্তিক কৃষকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংক মামলা করেছে। তথ্যমতে, মাত্র ৫০৫ কোটি টাকার কৃষিঋণ আদায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মামলায় সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪০৮টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ কৃষককে, যারা এখন মামলার ভয়ে মাঠে কাজ ছেড়ে হয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ লাগামহীনভাবে বাড়ছে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সহসাই এসব শিল্প মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। উল্টো রুগ্ণ শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে পুনঃতফসিলিকরণ কিংবা পুনরায় নতুন ঋণ দেওয়া হয়। যাদের ঋণের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। জুন প্রান্তিক শেষে ৫৭ ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। আবার রাহট অফ করা ঋণের অঙ্ক যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আগেই বলেছি, এসব ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা তো হয় না, উল্টো নানাভাবে ব্যাংকগুলো তাদের সহায়তা করে। অথচ মাত্র ৫০৫ কোটি কৃষিঋণের টাকা আদায়ে দুই লাখ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটা কতটা যৌক্তিক? যা সরকারকে ভেবে দেখা উচিত বলে আমরা মনে করি।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্টিফিকেট মামলা হ্রাসকরণ ও অনাদায়ী কৃষিঋণ আদায়ে মামলার বদলে বিকল্প পদ্ধতিকে অনুসরণের গুরুত্ব দিয়ে নির্দেশনা জারি করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তা উপেক্ষা করে কৃষিঋণ আদায়ে মামলার পথকেই বেছে নিয়েছে। যাদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর শ্রমে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মুখের আহার জোটে, সেসব কৃষকের প্রতি ঋণ আদায়ে এ ধরনের নীতি অবলম্বন বৈষম্যমূলকও বটে। দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান হলমার্কের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। যখন অর্থ আত্মসাতের ঘটনাকে ঘিরে গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে ওঠে, তখন প্রবীণ অর্থমন্ত্রী অবলীলায় বলেছিলেন, মাত্র সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু নয়! অথচ মাত্র ৫০৫ কোটি টাকা আদায়ে যখন দুই লাখ কৃষকের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো মামলা রুজু করল, তখন প্রবীণ অর্থমন্ত্রী যদি ওই সুরেই বলতেন, মাত্র ৫০৫ কোটি টাকার জন্য কেন আদালতে মামলা করা হলো? অর্থমন্ত্রীর এই নিয়ে কোনো মন্তব্য এখনো আমরা শুনতে পারিনি। তবে আমরা আশা করি, সরকারপ্রধান এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে কৃষিঋণ আদায়ে নির্দেশ দেবেন। আর যদি সরকারপ্রধানও এ ব্যাপারে নির্বাক থাকেন, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, মামলার জালে আটক কৃষকদের আবাদি জমি কিংবা বসতভিটা বিক্রি করে মামলার জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে, যা হবে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বেদনাদায়ক।

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, কৃষি অর্থনীতির বাংলাদেশের প্রাণ কৃষকের উন্নতি ব্যতীত প্রকৃত অর্থে দেশের সমৃদ্ধি অর্জন করাও সম্ভব নয়। মামলার জালে আটকে পড়া কৃষকদের বিরুদ্ধে কৃষিঋণ আদায়ে বর্তমান পথ থেকে ব্যাংকগুলোকে বিরত থাকতে হবে। আমরা মনে করি, কৃষিঋণ আদায়ে যেসব কৃষকের নামে মামলা হয়েছে, তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত সমঝোতা পদ্ধতিকে অনুসরণ করে ঋণ আদায় করাই হবে সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ।

লেখক : সমাজকর্মী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads