• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সৌন্দর্যের মহিমায় সম্ভাবনাময় আমাদের পর্যটন শিল্প

কুয়াকাটা সৈকত

সংগৃহীত ছবি

মতামত

সৌন্দর্যের মহিমায় সম্ভাবনাময় আমাদের পর্যটন শিল্প

  • প্রকাশিত ২৮ অক্টোবর ২০১৮

মো. আজহারুল ইসলাম

বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি সমৃদ্ধ এবং সফল শিল্প। পৃথিবীতে অনেক দেশ বিদ্যমান, যাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত এই পর্যটন শিল্প। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পর্যটন খাত তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তার মধ্যে ভারত, চীন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ অন্যতম। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র পথ পর্যটন শিল্প। এসব দেশে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে অসংখ্য মানুষ। ফলে জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ার সুযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। যেকোনো দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের চাকা গতিশীল করার জন্য পর্যটন শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ সাধন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, এসব দেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছে এই পর্যটন শিল্পের কারণে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়, পূর্ব সীমান্তে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমার এবং দক্ষিণ উপকূলের দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। বাংলাদেশকে ভৌগোলিকভাবে একটি উর্বর ব-দ্বীপ বলা যায়। ভৌগোলিকতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করা হয় পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ হিসেবে। এখানে রয়েছে পর্যটকদের দৃষ্টিকে সন্তুষ্ট করার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক আকর্ষণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তা ছাড়া বাংলাদেশ প্রাচীন সভ্যতার একটি দেশ। এদেশের সভ্যতার অজানা রহস্য পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে সবসময়। অতীতকাল থেকেই পর্যটকরা এই বাংলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করতে আসতেন তার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। ইবনে বতুতা আমাদের দেশে পরিব্রাজক হিসেবে ভ্রমণ করতে এসে বলেছিলেন, ‘এমন সুন্দর দেশ আর কোথাও দেখিনি।’

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্র একটি দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্রষ্টার কৃপার এক মহান দান আমাদের মাতৃভূমি। মায়ের মমতা দিয়ে ঘেরা সৌন্দর্যের লীলাভূমি অতীতকাল থেকেই পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ একটি পরিচিত নাম। হিমালয়ের পাদদেশে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নদীবেষ্টিত এই দেশের পর্যটন শিল্প অপার সম্ভাবনাময়। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং প্রাচীন সভ্যতার একটি কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অসংখ্য সম্পদ রয়েছে আমাদের। পর্যটন স্পটগুলোতে প্রচুর সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগও রয়েছে। বর্তমানে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এদেশের ত্রিশ লাখেরও অধিক মানুষ। বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান আরো বৃদ্ধি পাবে। আমাদের পর্যটন শিল্প নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত সুন্দরবন, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার আর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ একশ বিশ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ ইনানী সৈকত। বার-আউলিয়ার শহর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনার পশ্চিম তীরে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এবং নদীর মোহনার পূর্ব-দক্ষিণ তীরে পারকী সমুদ্রসৈকত। তিনশ ষাট আউলিয়ার শহর হিসেবে খ্যাত সিলেটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্তহীন। প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগে অসংখ্য নিদর্শন বিদ্যমান। যা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অফুরন্ত ভাণ্ডার ও মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়।

আমাদের পর্যটন এলাকা সুন্দরবনকে বলা হয় পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বলে বিবেচিত এই বনের ৬২ শতাংশ আমাদের দেশের খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালীর অঞ্চলসমূহ জুড়ে রয়েছে। জানা যায়, এই বনভূমিতে আছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। সুন্দরবনে দুই ধরনের হরিণ দেখা যায়— মায়া হরিণ ও চিত্রা হরিণ। বনের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কটকা, হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর ও টাইগার পয়েন্টে প্রতিবছরই দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটকদের আগমন ঘটে। সুন্দরবনের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত দুবলার চর (জাফর পয়েন্ট)। বনের ভেতর ছড়িয়ে রয়েছে জালের মতো ছোট-বড় অনেক নদী। নদীগুলোকে বলা হয় নোনা পানি ও মিঠা পানির মিলন স্থান। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা দাবি করেন, ‘গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের থেকে নোনা পানি মিলিত হয় এই এলাকায়।’ নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্রসহ অসংখ্য তৈজস সুন্দরবন থেকে আহূত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত হিসেবে বিবেচিত কক্সবাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম জায়গা। এখানে সাগরের মুহুর্মুহু গর্জন দোলা দিয়ে যায় ভ্রমণকারীদের। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন সাগরের বুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গগনের রবি। সুইজারল্যান্ডের New Seven Wonders Foundation কর্তৃক বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের আমাজান বন, ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপ প্রভৃতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ভালো অবস্থানেও ছিল। কক্সবাজারের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত হিমছড়ি, পাহাড় ও ঝরনা এখানকার উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ। এখানেই শেষ নয়, কক্সবাজারের ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইনানী সৈকত। ইনানী সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্রসৈকত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সাগর পাড়ে বালুর ওপর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে শত শত বছরের পুরাতন পাথর। অনেকে ইনানী সৈকতের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ বলে পরিচিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এটি বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে এবং টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। জানা যায় দ্বীপটি আজ থেকে ২৫০ বছর পূর্বে আরব নাবিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয় এবং দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৯ সালের হারিকেন এবং ২০০৪ সালের সুনামির ফলে এই দ্বীপের ব্যাপক ক্ষতি হলেও দ্বীপটির সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ কমেনি ভ্রমণপিপাসুদের। সকাল বেলার সূর্য উদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য এই দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। নভেম্বর এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের জন্য সুবিধাজনক সময়। এ ছাড়াও কক্সবাজার জেলায় রয়েছে কুতুবদিয়া ও সোনাদিয়া দ্বীপ। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে সোনাদিয়া দ্বীপ আর কুতুবদিয়া দ্বীপটির তিন দিক বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। বর্তমানে এই দ্বীপের বয়স ৫০০ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে কুতুবদিয়া দ্বীপকে উপজেলায় পরিণত করা হয়। তবে নিরাশার বিষয় হচ্ছে কুতুবদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের আনাগোনা খুবই কম।

সাগর কন্যা হিসেবে পরিচিত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, যা পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। কুয়াকাটা হচ্ছে দক্ষিণ-এশিয়ার একমাত্র সমুদ্রসৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত— দুটোই ভালোভাবে দেখা যায়। সবচেয়ে ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় সৈকতের গঙ্গামতির বাঁক থেকে আর সূর্যাস্ত দেখা যায় পশ্চিম সৈকত থেকে। এই সাগর কন্যার আয়তন ১৮ কিলোমিটার।

সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শেষ নেই। মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটে বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রকৃতির অসংখ্য লীলা খেলা। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান বলে বহুকাল ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে জাফলং। মেঘালয়ের কোল ঘেঁষেই জাফলং, আর জাফলংয়ের পরেই রয়েছে ঐতিহাসিক ডাউকি অঞ্চল। এই অঞ্চলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িত। যুদ্ধ চলাকালীন সিলেটের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল জাফলং সীমান্তের ওপারে ডাউকিতে। জানা যায়, জাফলংয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী বীর বাঙালিদের একাধিকবার মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানের উঁচু-নিচু পাহাড় এবং পাহাড় থেকে পতিত হওয়া আঁকাবাঁকা ঝরনা পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। ডাউকি নদীর স্বচ্ছ পানি ও ভারত সীমান্তে ঝুলন্ত সেতু পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। জানা যায়, শীতকালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০০-৯০০ জন দেশি-বিদেশি পর্যটক জাফলংয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করতে আসেন।

এই অঞ্চলের সৌন্দর্যের আরেক নাম বিছনাকান্দি। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানি ও পাহাড়ের ওপর মেঘের ছোটাছুটি এখানকার আকর্ষণ। নানা রঙের, নানা আকারের আর বিচিত্র সব উপাদানের পাথরে ভরপুর এই জায়গা। বাংলাদেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একমাত্র জলাবন রাতারগুল। এশিয়া মহাদেশের ২২টি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি জলাবন বলা হয় রাতারগুলকে। গুয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত মিঠাপানির এই জলাবনে রয়েছে পঁচিশ প্রজাতির উদ্ভিদ। বছরে ছয় থেকে সাত মাস এই উদ্ভিদগুলোর অর্ধাংশ থাকে পানির নিচে। এই দৃশ্য দেখে মনে হয় উদ্ভিদসমূহ যেন মাথা উঁচু করে বনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ডিঙি নৌকায় চড়ে বনের ভেতরের রূপ লাবণ্য অবলোকন করেন পর্যটকরা। এ ছাড়াও সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার হামহাম, পরিকুণ্ড ও মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত এবং  শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বন ও মাধবপুর লেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নক্ষত্রস্বরূপ। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হিসেবে খ্যাত হাকালুকিও রয়েছে এই অঞ্চলে।

এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল Tourism and Digital Transformation অর্থাৎ পর্যটন শিল্পের বিকাশে তথ্য ও প্রযুক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের মাতৃতুল্য ভূমিতে পর্যটন শিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে পর্যটন শিল্পের দিকে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তবুও পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দেওয়ার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। যদি এসব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে পর্যটন শিল্পে বৃদ্ধি পাবে নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা এবং সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র।

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads