• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নদ-নদীর জন্য এলিজি

আমাদের দেশ নদীমাতৃক

সংগৃহীত ছবি

মতামত

নদ-নদীর জন্য এলিজি

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০১৮

আমাদের বেশিরভাগ নদীই আজ বিপন্ন। দূষণ আর মানুষের লোভের ফাঁদে বন্দি। শ্রীহীন, স্রোতহীন। যৌবন হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলেছে। এখন আর সেভাবে দেখি না জোয়ার-ভাটার খেলা। স্রোতের উদ্দামতা। নৌকা-লঞ্চ-স্টিমারের নাচন।

আমাদের দেশ নদীমাতৃক। অর্থাৎ নদী আমাদের দেশের মা। অসংখ্য নদী অধ্যুষিত আমাদের এই দেশ। অতুলনীয় সুন্দর নামের নদীগুলো বয়ে চলেছে দেশের ভেতর দিয়ে সেই অতীত কাল থেকে। অনেক নদী চলতে চলতে গতি হারিয়েছে। চর পড়েছে নদীতে। মরেও গেছে। একই দশা জলাশয়গুলোরও।

কর্ণফুলী, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, গোমতী, বাঁকখালী, বোয়ালখালী, ইছামতি, পুনর্ভবা, সুরেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, হালদা, সাংগু, মাতামুহুরী, সন্ধ্যা, চিত্রা, কীর্তনখোলা, ভৈরব, রূপসার মতো নান্দনিক নামের নদী এদেশে। কিন্তু নদীকে আইনের আশ্রয় নিতে হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। আজ মানুষ নদীর প্রতিপক্ষ। মায়ের গর্ভ থেকে যেমন সন্তানের জন্ম হয়, বাংলাদেশের জন্ম তেমনি হয়েছে নদ-নদীর গর্ভ থেকে। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা যুগ যুগ ধরে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বহন করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। মোহনার মুখে এসে তারা বহন করা পলি সাগরে ঢেলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে চলেছে এই পলি বহন আর সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া। একসময় জেগে উঠেছে চর। ক্রমান্বয়ে সে চর উঁচু আর ভরাট হয়েছে। আস্তে আস্তে বিস্তৃত হয়েছে সাগরের উপকূল ধরে। এভাবেই জন্ম নিয়েছে সমতলভূমি। আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপই নয়, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ‘সক্রিয় ব-দ্বীপ’। তাই নদীকে এ দেশের মা বলা খুবই সঙ্গত। যে জন্ম দেয় সেতো মা-ই!

মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ এ স্লোগান মুখে নিয়ে লড়েছে দেশবাসী। এটা ছিল তাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের স্লোগান। নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে দেশের কৃষ্টি-অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজচেতনা ও  ইতিহাস ঐতিহ্য।

কালের প্রবাহে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার গতিপ্রবাহ অনেকবার দিক পরিবর্তন করেছে। কিন্তু পরিবর্তনের ফলে নদীগুলোর বঙ্গোপসাগর অভিমুখী প্রবাহের স্বাভাবিক ধারা বাধাগ্রস্ত হয়নি। প্রকৃতির আপন নিয়মে প্রবাহিত হয়েছে তারা। কিন্তু নদীর এই স্বাভাবিক গতি পরিবর্তনে শুরু হয়েছে স্বার্থান্ধ মানুষের নির্লজ্জ তৎপরতা। মানুষ শুরু করেছে প্রকৃতির গতিপ্রবাহকে বদলে দেওয়ার প্রয়াস ‘মনুষ্য-ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মাধ্যমে। অন্যদিকে নদী আক্রান্ত হচ্ছে ‘রাজনৈতিক ভূগোল’ দ্বারাও। এক্ষেত্রে প্রকৃতির ইচ্ছার চেয়ে ‘রাষ্ট্রের স্বার্থ’ প্রধান হয়ে উঠছে। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে রাষ্ট্রীয় সীমানা স্থির না করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিবেচনা করায় প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ হচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে  প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য।

নদী আমাদের মিঠা পানির প্রধান উৎস। মানুষ-পশু-পাখি এবং চাষাবাদসহ অনেক কাজের জন্য মিঠা পানির প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই। সাগরের নোনা পানি দিয়ে সবকিছু করা যায় না। নোনা পানিকে প্রক্রিয়াজাত করে মিঠা পানিতে রূপান্তরিত করা যায়, কিন্তু মানুষের বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য তা নিতান্তই অপ্রতুল। মিঠা পানির জন্য তাই মানুষ নির্ভর করে নদী, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদির ওপর। এ ছাড়াও নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের নিচে জমে থাকা মিঠা পানির স্তরের ওপর। তা ছাড়া বৃষ্টির পানিও মিঠা পানির একটি উৎস।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মিঠা পানির চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু যতটা মিঠা পানি প্রয়োজন তার সরবরাহ নেই। ফলে মিঠা পানির প্রাপ্তি নিয়ে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, মানুষে-মানুষে বিবাদ বাড়ছে। জন্ম হচ্ছে দ্বন্দ্ব আর বিরোধের। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর অধিকাংশ অভিন্ন নদী। যা একাধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ ধরনের নদী  রয়েছে ৫৭টি, যার ৫৪টি ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই ৫৪টির মধ্যে কয়েকটি ভারতে প্রবেশ করার আগে চীন, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতে ও পরে বাংলাদেশে এসেছে। তাই বাংলাদেশ রয়েছে একটি নাজুক অবস্থানে। নদী এদেশের অস্তিত্বের অংশ। তাই নদী নিয়ে বিরোধ এদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। যা দেশের জনগণের জন্য ক্রমবর্ধমান উৎকণ্ঠার কারণ।

নদী ব্যবস্থাপনা নীতি কেমন হওয়া উচিত- এটা একটা প্রশ্ন। এ নীতির প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিত, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যবস্থাপনা করা। ভারসাম্যের প্রতিকূল কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকা। নদীকে বাঁচানোর নীতি মেনে চলা। নদ-নদীর স্বাভাবিক যাত্রাপথ, স্রোত, বহনকৃত পলি ও জলজ-জীবের স্বাভাবিক চারণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ইত্যাদি ক্ষুণ্ন না করা।

এ ছাড়াও রয়েছে নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক’ মনোভাব। অন্য দশটি জিনিসের মতো নদীকে বৈষয়িকভাবে ব্যবহারের চিন্তা। নদীকে মুনাফা বানানোর উপকরণ ভাবা। আমরা প্রায়ই দেখি নদীর অংশ, হাওর, জলাশয়ের সম্পদ দখল করে নিচ্ছে ইজারাদাররা। নদ-নদী, খাল-বিল ক্রমান্বয়ে ভরাট করে দখল করে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। এভাবেই সঙ্কুচিত হতে হতে মরে যাচ্ছে বেশিরভাগ ছোটখাটো নদ-নদী, খাল-বিল। ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা থেকেই এ ধরনের নীতি ও মনোভাবের উদ্ভব ঘটেছে। আলো-বাতাসের মতো নদ-নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি হলো মানুষের ‘যৌথ সম্পত্তি’। কিন্তু পুঁজিবাদ সবকিছুর পণ্যায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ, অ-যৌথায়ন তথা ব্যক্তিগতকরণ ঘটায়। পুঁজিবাদের ক্রমপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে বাড়ছে এই প্রবণতা। নিস্তার পাচ্ছে না কিছুই।

নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এই পুঁজিবাদী বাণিজ্যিকীকরণের  মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে উজানের ও ভাটির দেশের মধ্যে পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে।

নদীর স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা দরকার। সেজন্য যে পরিমাণ পানিপ্রবাহ প্রয়োজন, তার বরাদ্দ প্রথমেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট পানি প্রবাহের পরিমাণকে সংশ্লি­ষ্ট দেশগুলোর জন্য সমতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে বরাদ্দ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন উজান বা ভাটির দেশ যেন একে অপরের ক্ষতিসাধন হতে পারে- এমন কোনো স্থাপনা নদীতে না করে, সেটা দেখা। পাশাপাশি নদী ব্যবস্থাপনায় পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতামূলক আলোচনার পথ অনুসরণ করা।

ভূমিদস্যু-নদীদস্যুদের অবৈধ দখলের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো আদালতে যায়। কর্ণফুলী, কপোতাক্ষ, করতোয়া-ইছামতি, বালু-তুরাগ, বুড়িগঙ্গা নদী আদালতে গেছে। রায় পেয়েছে। কার্যকারিতা পায়নি।

২০১০ সালে কর্ণফুলী কোর্টে যায়। আদালত নির্দেশনা দেয় তিন মাসের মধ্যে স্থাপনার পরিসংখ্যান কোর্টে দাখিল করতে। সময় গড়িয়ে যায় পাঁচ বৎসরাধিক কাল। ২০১৬ সালের জুন মাসে নৌবাহিনীর তিনটি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি মিলিয়ে সরকারি এ ছয়টি বাদে দুই হাজার একশ একাশিটি স্থাপনাকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অবহিত করানোর নির্দেশনা আসে আদালত থেকে। বিজ্ঞাপন প্রকাশের ৯ মাসের মাথায় আরএস খতিয়ান অনুসারে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার কথা। উচ্ছেদ হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না। কর্ণফুলীতে যে উচ্ছেদ হলো না এই নিয়ে ভাবারও লোক নেই।

দেশের সামাজিক, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই এ বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা নেয়। তাও অবশ্য দিবসকেন্দ্রিক। বিশ্ব নদী দিবসে এ বিষয়ে উচ্চারণ বেশি হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আমাদের সাময়িকভাবে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবায়। আমরা উদ্বেগ আর আশঙ্কা প্রকাশ করি।

দেশের শহর-বন্দরকেন্দ্রিক নদীগুলো বেশি দুরবস্থার শিকার। এসবের দূষণ বেশি, দখল বেশি, অত্যাচার ও অমানবিকতা বেশি। কারণ এ নদীর মাটির দাম বেশি, এলাকার দাম বেশি, মুনাফা বেশি হয়, এদের জন্য আমাদের ভাবনাও বেশি।

নদীকে ঘিরেই আমাদের অর্থনীতি-সংস্কৃতির বিকাশ হলেও নদীকে আমরা গল্প কবিতাতেই ভালোবাসি, বাস্তবে নয়। কর্ণফুলী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নদীটি ২০১১ সালে মহাখননের আওতায় আসে। ২৩০ কোটি টাকার তিন প্রকল্প অবশেষে অপূর্ণই থেকে গেছে। নদীটির প্রতি আমাদের অবহেলার মাত্রা সব সীমানা অতিক্রম করেছে। ঢাকার চারপাশের চার নদী বাঁচাতে কোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দশ বছর আগে। নির্দেশনা ছিল নদীতীরের অস্থায়ী, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। সীমানায় পাকা খুঁটি বসাতে হবে। তীরে হাঁটার পথ, বনায়ন, নদী খনন, নদীতীরের জমি জরিপ প্রভৃতি কার্যক্রম করতে হবে।  নির্দেশনাগুলো পালিত হয়েছে বলে আমরা জানি না। কোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়ার পর সেটা কতটা কী করা হলো তার মূল্যায়ন হয়েছে কি না আমরা জানি না।

একইভাবে ২০১০ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রমনাবাদ নদীতীর ভরাটের নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। আগের অবস্থা। কলাপাড়ার শিববাড়ীয়া নদী দখলমুক্ত করতে কোর্টের নির্দেশনার অবস্থাও তাই।

২০১২ সালে কপোতাক্ষ নদ ভরাটের ওপর হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০১৪ সালে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী দখলমুক্তকরণের নির্দেশনা জারি করে কোর্ট। পাবনার ইছামতি ২০১৩ সালে দখলমুক্তির নির্দেশনা পায় কোর্ট থেকে। তেমনি আশুগঞ্জের মেঘনার দখলমুক্তির নির্দেশনাও কার্যকারিতা অদ্যাবধি পায়নি।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ২০০০ সালের জলাধার আইন অনুসারে জলাশয় ভরাট ও নদীভরাট বেআইনি। অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে।

বিশ্ব নদী দিবসে আমরা জাঁকজমকভাবে নানা অনুষ্ঠান করি। র্যালি, আলোচনা, সেমিনার হয়। আমরা নদীর জন্য কাঁদি। সে কান্নায় নদী বেঁচে ওঠে না। প্রতিবছর মৃতের মিছিলে যোগ হয় আরো কিছু নদী। সে দিন আর দূরে নয়, যেদিন মৃত নদীর জন্য আমাদের শোকসভা করতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্মসচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads