• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রা

এজেন্ট ব্যাংকিং

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রা

  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০১৮

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

এজেন্ট ব্যাংকিং এখন আর শুধু একটি নাম নয়, এখন এটি একটি সফল উদ্যোগ। যে উদ্যোগে সত্যিকারভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ঘটে চলেছে। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা ১৮ লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। বলা হচ্ছে, গ্রামের মানুষ যারা কখনই ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার চিন্তা করেননি, তারাই আজ ব্যাংকের গ্রাহক। তাদের সঞ্চয় থাকত ঘরের বাঁশের বক্সে অথবা মাটির ব্যাংকে। কিন্তু এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যুগান্তকারী সফলতার কারণে আজ টাকা থাকছে ব্যাংকে। ফলে দেশে সঞ্চয় বাড়ছে, মানুষ টাকা সঞ্চয় করতে উৎসাহিত হচ্ছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। ফলে আমানত বাড়ছে। সেই আমানত থেকে ঋণ যাচ্ছে দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে দ্রুতগতিতে। নতুন নতুন ব্যাংকিং সেবা নিয়ে ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। ব্যাংকের শাখা খোলা যেখানে অনেক ব্যয়বহুল ছিল, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বদৌলতে অনেক কম খরচে ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণ ব্যাংকিং সেবা দিতে সক্ষম হচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের একটি আউটলেটে কমপক্ষে ৩-৪ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। একজন এজেন্ট একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন। এটি ব্যাংক এবং ব্যাংকের এজেন্ট উভয়ের জন্য লাভজনক অবস্থান। আখেরে এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি নতুন উদ্দীপক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পক্ষে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন সংগ্রহ, বিভিন্ন ধরনের আমানত সংগ্রহ, পল্লী বিদ্যুৎ বিল গ্রহণ, বিভিন্ন ফি আদায়, রেমিট্যান্স সেবা, ঋণ বিতরণ ও আদায়সহ অন্যান্য ব্যাংকিং সেবা প্রদান করতে পারছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ জন এবং মোট আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ১২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৭ জন এবং মোট আমানতের পরিমাণ ১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুন মাস শেষে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৬৫ জন। এক বছরের ব্যবধানে গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে ৯ লাখ ৫ হাজার ৪০০ জন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ২০টির মতো ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জন্য অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের প্রথম নীতিমালায় প্রথমে শুধু পল্লী এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অনুমতি দেওয়া হলেও পরে নীতিমালায় কিছুটা সংশোধন আনা হয়। সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই এমন পৌর ও শহর অঞ্চলেও এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া যায়। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে তিনটি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট খোলা হলে শহরে একটি আউটলেট খোলা যাবে। ফলে গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরেও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দেখা যায়।

ব্যাংকগুলো আজকাল শুধু উদ্বৃত্ত তারল্যই সংগ্রহ করে না, বরং আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের আমানত প্রবণতা তৈরির কাজ করে থাকে। যার ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার বিনিয়োগের চেয়ে বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা যখন অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম, তখন পড়েছিলাম স্বল্প সঞ্চয়ের কারণে দেশে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল গড়ে ওঠেনি, তাই বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। দেশ স্বল্প আয়, স্বল্প সঞ্চয় আর স্বল্প বিনিয়োগের কারণে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু এজেন্ট ব্যাংকিং এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কারণে সেই বাধা অনেকাংশে দূরীভূত হচ্ছে। দেশে এটিএম সেবা এবং সবচেয়ে বেশি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের পথিকৃৎ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরীনের মতে, ‘সামনের দিনগুলোতে শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং বিস্তৃতি ঘটবে না, বাড়বে ব্যাংকিং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবার বিস্তৃতি।’ এজেন্ট ব্যাংকিং হচ্ছে এমনি একটি আউটসোর্সিং যার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার পরিধি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে।

যেকোনো নতুন উদ্যোগকে জনপ্রিয় এবং টেকসই করতে হলে উদ্যোক্তাদের কাছে এটাকে লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হতে হয়। কিছু দিন আগে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়েও ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যাপ্ত ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করা যায়নি, কিন্তু আজ এই শিল্পে ঋণ প্রদান করতে ব্যাংকগুলো নিজে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলস্বরূপ এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ ফি বছর বাড়ছে। এই খাতের ঋণ বিতরণ ও কিস্তি আদায় এখন এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে করা সম্ভব হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক এরই মধ্যে ঋণ সেবা চালু করেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাতে বাংলাদেশের ভূমিকা বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ সামনে এগিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সম্প্রসারণ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে মধ্যম আয়ের দেশে এবং সেটা সম্ভব ২০২১ সালের মধ্যেই। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার জয়যাত্রায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অংশগ্রহণ দিনে দিনে বাড়ছে এবং এটি যত দ্রুত বাড়বে তত দ্রুতই দেশের অর্থনীতি আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।  

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

anwarfaruq@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads